পাতা:আত্মকথা - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ইহার পরে আমার মাতামহী ঠাকুরাণী ও আমার বড়মামী আসিয়া কিছুদিন কলিকাতাতে ছিলেন। তঁহাদের পদার্পণে বাস। পবিত্র হইয়া গেল। মাতুল মহাশয়ের শনিবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ হইল। মামীঠাকুরাণী মাতুলের তৃতীয় পক্ষের পত্নী, আমা অপেক্ষ চারি-পাঁচ বৎসরের বড়। তিনি মাতামহীকে গোপন করিয়া আমাকে মিঠাই আনিতে পয়সা দিতেন, মিঠাই আনিয়া রাত্রে দুইজনে খুব খাইতাম । এ পেটুকের সেই সময়টা যে কি সুখেই গিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না । অগ্রে বলিয়াছি, বড়মামার কাছে একবার একটি মিথ্যা কথা বলিয়াছিলাম, তাহার বিবরণ এখানে দিতেছি। আমার দুইজন সহাধ্যায়ী বন্ধুর জননীকে আমি মাসী বলিতাম ও তাঁহাদের বোনকে বোন বলিতাম । তঁহাৱা! বাস্তবিক আমাকে মাসীর ন্যায় ভালবাসিতেন । এই দুই বন্ধুর মধ্যে একজনের বাড়িতে আমরা কয়েকটি বালক একবার এক ছুটির দিনে সম্মিলিত হইয়াছিলাম। নানা প্রকার ক্রীড়া কৌতুকের মধ্যে একটি বালক একখানা বোতল-ভাঙ্গা কঁাচ লইয়! হাসিতে হাসিতে বলিল, “দেখ ভাই, এই কঁাচ যদি কেহ চিবাইয়া ভাঙিতে পারে, তবে তাকে এখনি এক টাকা দি ” আমি বলিলাম, “আচ্ছা দাও, আমি চিবচ্ছি।” এই বলিয়া তাহার হাত হইতে কঁাচখানা লইয়া চিৰাইতে প্রবৃত্ত হইলাম। যেমন দুই পাটী দন্তের মধ্যে বঁচিখানা রাখিয়া ভাঙিতে যাইব, আমনি ডান দিকের নিচের ঠোঁট কাটিয়া দুখান হইয়া গেল । এই অবস্থায় মাতুলের বাসাতে দৌডিলাম। বড়মামা দেখিয়া ভয়ে আকুল হইলেন । কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বলিলাম যে, একখানা চকু-চুরি বাহাদুরি করিয়া দাঁত দিয়! তুলিতে গিয়াছিলাম। ছুরিখানা কিয়দীর উঠিয়া সবেগে ঠোঁটের উপর বসিয়া গেল। মামা তাহাঁই বিশ্বাস করিলেন এবং ডাক্তার ডাকিয়া আমার ঠোঁট সেলাই করাইয়! দিলেন । আমি তাহার নিকট এই একটি মিথ্যা কথা কহিয়াছিলাম। এখনো ইহা স্মরণ হইয়। লক্ষা হইতেছে, কারণ আমার সত্যবাদিতার প্রতি তঁহার প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। আমি তাহার নিকট কখনো কোনো মিথ্যা কথা বলিয়াছি বলিয়া স্মরণ হয় না । বলিতে কি, আমাকে তিনি কিরূপ বিশ্বাস করিতেন তাহ যখন ভাবি, আমার মন আশ্চর্যান্বিত হয়। পাছে তিনি ক্লেশ পান, এই ভয়ে সর্বদা কুসঙ্গ হইতে দূরে থাকিতাম। তিনি দৃঢ়চেতা কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন, তামাক পর্যন্ত খাইতেন না, ধীর গম্ভীরভাবে সকল কাজ । করিতেন, দিন রাত্রি পাঠে মগ্ন থাকিতেন। তঁহাকে না দেখিলে, তাহার চক্ষের সমক্ষে । বর্ধিত না হইলে, আমার মনে যত সাধুভাব জাগিয়াছিল, তাহা জাগিতা না। তােহাৱ নিকট এই মিথ্যা কথা বলিয়া বহুদিন কষ্ট ভোগ করিয়াছি। মাতুলের কলিকাতার বাসার খার্কিবার কালের আর একটি হাস্যজনক ঘটনা আছে।