পাতা:আত্মকথা - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাখি ! এখনি ঘরা হতে বের হয়ে যা, নতুবা গলাধাকা দিয়ে বের কয়ে দেব।” আমি গিয়া । কাছে দাড়াইলে আমাকে বলিলেন, “কি ভাই, নবীনঠাকুর তোমাকে কি বলেছে, - বল তো ।” আমি বলিলাম, “বেশি কিছু বলে নাই, সামান্য একটা কথা বলেছে, সে । জন্য রাগ করছেন কেন ?” বড়দা বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আঃ ! কি বলেছে, তাই বল না । সামান্য কি বেশি, আমি বুঝব।” তখন আমি বুলিলাম, “ও বলেছে, ওদের সঙ্গে লাগলে আমি টিকতে পারব না ।” বড়দা বলিলেন, “বলতে বাকি রেখেছে কি ? দু। ঘা জুতা মারলে কি সন্তুষ্ট হতে ? ঐ জন্যেই লোকে তোমাদের অপমান করতে সাহস পায়।” এই বলিয়া নবীনঠাকুরের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “যা, এখানকার কর্ম গেল ; এখানে তো টিকতে পারলিই না, তারপর গ্রামে টিকতে পারিস কি না, পরে ভাববা।” (তাহার আমদপুর গ্রামের জমিদার ছিলেন, ও নবীন তাহদের প্রজা ছিল ) । নবীন তঁহাদের গৃহ হইতে তাড়িত হইয়া গিয়া পথের ধারে বাজারে এক দোকান আশ্রয় করিল । আমি স্কুলে যাইবার জন্য বাহির হইলেই দেখিতাম, নবীন বিষন্ন মুখে দোকানে বসিয়া আছে । আমার মনে মহা সংগ্রাম উপস্থিত হইল । আমি ভাবিতে লাগিলাম, আমি গরীব ব্রাহ্মণের ছেলে, এও গরীব ব্রাহ্মণ, আমার জন্য এ ব্যক্তির কর্ম যায়, এটা প্রাণে সহ্যু হয় না । অবশেষে একদিন বড়দা কোর্ট হইতে আসিয়া বাহিরের উঠানে বেড়াইতেছেন, এমন সময়ে নবীনের জন্য তঁহাকে অনুরোধ করিতে গেলাম । তিনি গম্ভীর প্রকৃতির লোক ছিলেন, গায়ে পড়িয়া কথা কহিতে ভয় হইত, সুতরাং আমি নীরবে বলি-বলি করিয়া তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে বেড়াইতে লাগিলাম । তিনি আমাকে পশ্চাতে বেড়াইতে দেখিয়া ফিরিয়া দাড়াইলেন ; বলিলেন, “কি ভাই, আমাকে কিছু বলবে নাকি ?” আমি বলিলাম, “আপনি নবীনঠাকুরকে মাপ করুন, নতুবা আমার মন খারাপ হচ্ছে।” তিনি বলিলেন, “ছিঃ ! তোমরা বড় মিস্কিমাইণ্ডেড । সে আপনার কাজের ফল ভুণ্ডক । দু-দশদিন যেতে দাও না।” আমি বলিলাম, “সে নিরাশ্রয় হয়ে বাজারের দোকান আশ্রয় করেছে, মাথা রাখবার স্থান নাই, খাবার সম্বল নাই, এটা আমার সহ হচ্ছে না ।” তখন তিনি চাকর পাঠাইয়া নবীনঠাকুরকে বাজার হইতে ডাকাইয়া আনিয়া বলিলেন, “দেখ রে দেখ, তুই কি মানুষের অপমান করেছিস ; তোর জন্য আমার কাছে মাপ চাচ্ছে। এর জন্যই তোকে এ আসতে দিলাম। যা, কাজ করগে যা ।” নবীন স্বীয় কর্মে প্রতিষ্ঠিত হইল, আমার প্রাণের উদ্বেগ চলিয়া গেল। সেদিনকার সে ঘটনা ও মহেশচন্দ্র চৌধুরীর আকৃত্রিম - ভালোবাসা চিরদিন স্মৃতিতে জাগিয়া রহিয়াছে।