পাতা:আত্মকথা - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হইত। কঁচা তেতুলি দিয়া সেই বোয়াল মাছের আয় রান্না হইত-তাহ খাইতে অমৃততুল্য হইত।--রাশি রাশি খাইতাম, কিছুমাত্র অসুখ হইত না। এখন ইস্কুল পাঠশালায় স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্রন্থে পড়িয়া আমরা শিখিতেছি যে এ-মাছ যে মাছ খাইলে অসুখ হয় তাই মাছ খাওয়ায় সেকালের সে বীরত্ব আর নাই ৷ প্রকৃতার্থে স্বাস্থ্যবিষয়ক গ্রন্থগুলিতে স্বাস্থের বড় হানি করিতেছে আর কিছুতে তত করিতেছে কিনা সন্দেহ। ডোতে যখন আর বেশী মাছ পড়িত না, তখন তাহা ভাজিয়া ফেলিয়া সমস্ত নদী গাবান হইত ; অর্থাৎ নদীর জল এমনই আলোড়িত করা হইত যে, তলার পাক উপরে উঠিয়া পড়িত, সমস্ত জল ঘোলা হইত, আর সমস্ত মাছ তাড়া পাইয়া ভাসিয়া উঠিত। আমরা ছেলেরা নদী গাবাই তাম, আর সেই মাছ ধরিতাম। অধিকাংশই টেংরা মাছ । কিন্তু টেংরার কঁাটার ভয় করিতাম না । টপাটপ ধরিতাম, আর কেঁচড়ে ফেলিতাম। উপরে অসংখ্য চিল উড়িতেছে, জলে অসংখ্য মাছ ছুটিতেছে, আমরা অদম্য সাহসে এবং অসীম আনন্দে একবেলা ধরিয়া পাক ভাঙ্গিয়া মাছ ধরিতেছি, আর সেই ডুমুর গাছের তলায় মাকাল ঠাকুরের পূজা হইতেছে। শেওড়াফুলি হইতে তারকেশ্বর পর্য্যন্ত রেল বসিয়াছে। পোড়া রেল রাস্তার জন্য আমাদের সেই ডুমুৱা গাছটি মারা গিয়াছে। পোড়া পথটা ঐখানে দু’হাত বঁকাইয়া লইয়া গেলে আমাদের মনে এত ঘা লাগিত না । একটু বিবেচনা করিয়া লোকের প্রিয় বস্তুর প্রতি একটু একটু লক্ষ্য রাখিয়া রেলপথ নির্ম্মান করিলে উহা এত অভিশাপগ্রস্ত হয় না ; লোকের মর্ম্মান্তিক দুঃখের কারণও হয় না। কি আনন্দের ব্যাপার, এই বৃদ্ধ বয়সে চক্ষু বুজিয়া তাহ আবার প্রত্যক্ষ করিয়াছি—সেই অতুলনীয় নির্ম্মল আনন্দ শরীরী হইয়া আবার আমার কাছে আসিয়া আমাকে কোল দিয়াছে। বিধাতার কি করুণা, মানুষের জন্য তিনি অসীম সুখের কি সহজ, সুন্দর ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন। তবু মানুষ বলে, জগতে সুখ নাই, কেবলই দুঃখ । মানুষ বড়ই নিমকহারাম, ঈশ্বরে অনস্থাবান-নিহিলে শৈশব হইতে মৃত্যু পর্য্যন্ত সুখের স্রোতে ভাসিত, আনন্দের ঢেউ সামলাইতে পারিত না । আর কবি Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. এরূপ গান না। গাহিয়া গাহিতেন,- Our sweetes songs are those that tell of purest thought. বাল্যকাল অতিক্রম করিয়া যৌবনে প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছি, যাহাকে Puberty বা যৌবনোভেদ বলে, তাহা ঘটিলে বুঝিতে পারা যায়, মন মলিন হইয়া পড়িয়াছে। শৈশবের সে রৌদ্রের সেই রং, উদ্ভিজের সেই রং, বাতাসের সেই সুন্দর শাপ্তিময় নিশ্বাস আর নাই--অন্তর্জগৎ বহির্জগৎ সবই যেন মলিন বা আবিল হইয়া উঠিয়াছে । SP