পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আত্মচরিত

হইয়াছিলেন; কেননা, আমার ঠাকুরদাদার তিনি একমাত্র পুত্র ছিলেন (আমার পিতৃব্যেরা সকলেই অকালে পরলোকগমন করেন)। ঠাকুরদাদা যশোর আদালতে সেরেস্তাদারের কাজ করিতেন (তখনকার দিনে এই সেরেস্তাদারের কাজে বেশ অর্থাগম হইত); সুতরাং বাড়ীতে পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশনা করিবার কেহ রহিল না। আর একটা কারণ বোধ হয় এই যে, মধসমূদন দত্ত এই সময়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাহার ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজে এক আতঙ্কের সাড়া পড়িয়া যায়। ঠাকুরদাদার ভয় হইল যে, হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা যে সব বিজাতীয় ভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত হইত, সেই সব গ্রহণ করিয়া আমার পিতাও হয়ত পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করিবেন।

 এইখানে আমি আমাদের বংশের ইতিহাস এবং পারিপার্শ্বিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু পরিচয় দিব। ‘বোধখানার’ রায়চৌধুরী বংশ চিরদিনই ঐশ্বর্যশালী, উৎসাহী এবং কর্মকুশল বলিয়া পরিচিত। এই বংশের অনেকে নবাব সরকারে উচ্চ পদ লাভ করেন এবং যশোরের নূতন আবাদী অঞ্চলে অনেক ভূসম্পত্তি ও জায়গীর পান।[১]

 ১৪শ, ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে মুসলমান পীরগণ প্রথম ধর্মপ্রচারকসুলভ উৎসাহ লইয়া এই যশোর অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের পতাকা বহন করিয়াছিলেন এবং তথায় লোক-বসতি গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। এই অঞ্চলের ইতস্ততঃ বহু গ্রামের নামই তাহার জ্বলন্ত সাক্ষ্য স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে, যথা— ইসলামকাটি, মামুদকাটি,[২] হোসেনপুর, হাসানাবাদ (হোসেন-আবাদ) ইত্যাদি। ইসলামের এই অগ্রদূতগণের মধ্যে খাঞ্জা আলির নাম সর্বপ্রধান। ইনিই প্রায় ১৪৫০ খৃঃ—বাগেরহাটের নিকটে বিখ্যাত “ষাট গম্বুজ” নির্মাণ করেন। রাডুলির প্রায় দশ মাইল দক্ষিণে আর একটি মসজিদও এই মুসলমান-পীরের নির্মিত বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে।

 সুন্দরবন অঞ্চলে আবাদ করিবার সময়, কতকগুলি লোক জঙ্গল পরিষ্কার করিতে করিতে কপোতাক্ষী নদীতীরে, চাঁদখালির প্রায় ছয় মাইল দক্ষিণে, একটি প্রাচীন মসজিদ মৃত্তিকার নিম্নে প্রোথিত দেখে; সেইজন্য তাহারা গ্রামের নাম রাখে “মসজিদকুঁড়”। এই মসজিদটি দেখিলেই বুঝা যায় যে, ইহা “ষাট গম্বুজে”এর নির্মাতারই কীর্তি।

 আমার কোন পূর্বপুরুষ জাহাঙ্গীর বাদশাহের আমলে বা তাহার কিছু পরে এই গ্রামে আসিয়া বাস করেন। নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামে তাঁহার জায়গীর ছিল। আমার প্রপিতামহ মাণিকলাল রায় নদীয়া ও যশোরের কালেক্টরের দেওয়ানের উচ্চপদ লাভ করিয়াছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম আমলে দেওয়ান, নাজির, সেরেস্তাদারগণই ব্রিটিশ কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজদের দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ ছিলেন।

 বাংলার নবাবদের আমলে এবং ওয়ারেন হেষ্টিংস এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকাল পর্যন্ত রাজকার্যে উৎকোচ গ্রহণ প্রভৃতি নানা জঘন্য অনাচার যে ভাবে চলিয়াছিল,


  1. যে সব পাঠক এ সম্বন্ধে আরও বেশী জানিতে চাহেন, তাঁহারা সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ পড়িতে পারেন।
  2. কাটি (কাষ্ঠখণ্ড) — সুন্দরবনে জঙ্গল কাটিয়া যে সব স্থানে বসতি হইয়াছে, সেখানকার অনেক গ্রামের নামের শেষেই এই শব্দ আছে।
     ওয়েস্টল্যাণ্ডের ‘Report on the District of Jessore’ ২০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। হাণ্টার যথার্থই বলিয়াছেন,—বাঙ্গালী জমিদার এই কথা বলিয়া গর্ব করিতে ভালবাসেন যে, তাঁহার পূর্বপুরষে উত্তর অঞ্চল হইতে আসিয়া জঙ্গল কাটিয়া গ্রামে বসতি করেন। যে পুকুর কাটাইয়া, জমি চাষ করিয়া বসতি করে সেই এখনও গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া গণ্য।