পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪২
আত্মচরিত

আগুনের কাছে আরাম কেদারায় বসেন, তখন তিনি মুখে মুখে ছেলেদের নানা বিষয় শিখাইতে আলস্য করেন না। তাঁহার নিজের জ্ঞানও খূব সঙ্কীর্ণ নহে, ইয়োরোপের ইতিহাস এবং গ্রেট ব্রিটেনের সাহিত্য তিনি জানেন। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব, কাব্য এবং স্কটল্যাণ্ডের ইতিহাসই তাঁহার বিশেষ প্রিয়। স্কটল্যাণ্ডের ইতিহাসে যেসব যুদ্ধ, অবরোধ, সঙ্ঘর্ষ, পারিবারিক বা জাতীয় কলহের কথা কোন ঐতিহাসিক লিপিবদ্ধ করেন না, একজন বুদ্ধিমান কৃষক, সে সমস্ত জানেন; বড় বড় বংশের ইতিহাস তাঁহার নখদর্পণে। স্কটল্যাণ্ডের গীতি কবিতা, চারণ গাথা প্রভৃতি তাঁহার মুখস্থ, এমন কি অনেক সুদীর্ঘ কবিতাও তাঁহার মুখস্থ আছে। যে সব ব্যক্তি স্কটল্যাণ্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি করিয়াছেন, তাঁহাদের জীবনের কথা তাঁহার জানা আছে। এসব তো তাঁহার স্মৃতিপটেই আছে, ইহা ছাড়া তাঁহার শেলফের উপর পূথিপত্রও আছে। স্কটল্যাণ্ডের সাধারণ কৃষকের গৃহেও একটি ছোট খাট লাইব্রেরী থাকে,——সেখানে ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব এবং বিশেষ ভাবে কাব্যগ্রন্থাদি আছে। মিলটন এবং ইয়ং তাহাদের প্রিয়। হার্ডের চিন্তাবলী, ‘পিগ্রিস প্রোগ্রেস', সকল কৃষকের ঘরেই আছে। যাঁমজে, টমসন, ফার্গুসন, এবং বার্নস প্রভৃতি স্কচ লেখকদের গ্রন্থ, গান, চারণ গাথা, সবই ঐ গ্রন্থাগারে একত্র বিরাজ করিতেছে; বহ, ব্যবহারের ফলে ঐগুলির মলাট হয়ত ময়লা হইয়াছে, পাতা গুলি কিছু কিছু ছিন্ন কীটদষ্ট হইয়াছে।”

 রক্ত সংমিশ্রণের ফলে species বা শ্রেণীর উন্নতি হয়, সন্দেহ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় সামাজিক প্রথা জাতিভেদের উপরে প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং ইহার ফলে বংশানুক্রমিক উৎকর্ষ হয় না এবং নিম্ন স্তরের জাতিরাও উন্নতি লাভ করিতে পারে না। এই জাতিভেদ প্রথার ত্রুটি ভারতীয় মহাজাতির, অথবা যে কোন রক্ষণশীল দেশের ইতিহাস আলোচনা করিলেই বুঝা যাইতে পারে।

 ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম অবস্থায়, উচ্চবর্ণীয়েরাই (শিক্ষিত সম্প্রদায়) সর্বাগ্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার সংযোগ লাভ করিয়াছেন। ব্রিটিশ শাসন যখন সাদঢ় হইল, তখন আদালত স্থাপিত ও আইনকানুন বিধিবদ্ধ হইল। আমলাতন্ত্রের শাসনযন্ত্র সপ্রতিষ্ঠিত হইল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহও গড়িয়া উঠিল। সুতরাং আইনজীবী, স্কুল মাষ্টার, সেক্রেটারিয়েটের কেরাণী, ডাক্তার প্রভৃতির চাহিদা খুব বাড়িয়া গেল। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সহিত সংসৃষ্ট অসংখ্য কলেজের সৃষ্টি হইল এবং সেখানে দলে দলে ছাত্রেরা ভর্তি হইতে লাগিল; কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী বা উপাধিই পূর্বোক্ত ওকালতী, ডাক্তারী, কেরাণীগিরি প্রভৃতি পদ লাভের প্রধান উপায় ছিল। কিছু কাল ব্যবস্থা ভালই চলিতে লাগিল। কতক গুলি উকীল, ডাক্তার প্রভৃতি প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। কলিকাতা হাইকোর্টের তথা জেলা কোর্টের কতক গুলি জজের পদও ভারতবাসীকে দেওয়া হইল। শাসন ও বিচার বিভাগের নিম্ন স্তরের কাজগুলি সম্পর্ণরূপে ভারতবাসীদেরই দেওয়া হইতে লাগিল। কেন না ঐসব পদের জন্য যে বেতন নির্দিষ্ট ছিল, তাহাতে যোগ্য ইয়োরোপীর কর্মচারী পাওয়া যাইত না। এইরূপে এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় কেবল যে তাহাদের সক্ষম মস্তিষ্ক চালনার ক্ষেত্র পাইল তাহা নহে, তাহাদের জীবিকার্জনের পথও প্রশস্ত হইল।

 কিন্তু অন্য দিক দিয়া, এই অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম ব্যবস্থা সমাজদেহকে বিষাক্ত করিয়া তুলিতে লাগিল। শুনা যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও যক্ষ্মার প্রথম অবস্থায় প্রতারিত হন, উহা তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যায়। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উচ্চশিক্ষার প্রতি মোহের ফলে এখন ভীষণ প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। তাহারা সভয়ে দেখিল যে, তাহাদের সঙ্কীর্ণ কার্যক্ষেত্রে বিষম ভিড় জমিয়া গিয়াছে। ব্যবসা বাণিজ্য ইতিমধ্যেই অন্য লোকের হাতে চলিয়া গিয়াছে এবং ইহার অপরিহার্য পরিণাম বেকার সমস্যা ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করিতেছে।