পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আত্মচরিত

বিদ্যাভ্যাসে একাগ্রতা জন্মিয়াছে। অল্পবয়স্ক শিশুগণের অন্তঃকরণে পরিশ্রমের পুরস্কার ছাত্রবৃত্তি প্রাপ্তের অভিসন্ধি সংস্পর্শে বিদ্যাশিক্ষার একান্ত অনুরাগ সঞ্চার, সতরাং না হওয়ার বিষয় কি? এত অল্পকালের মধ্যে বিদ্যার্থিগণের এতদনুরূপ ফললাভ হইবেক ইহা মনোরথের অগোচর। বিদ্যালয় সংস্থাপনাবধি দিন গণনা করিলে ইহার বয়ঃক্রম দুই বৎসর অতীত হয় নাই, তাহার তুলনা এরূপ হওয়া কেবল উপদেষ্টাগণের সদুপদেশ শিক্ষাপ্রণালীর সুকৌশলেরি মাহাত্ম্যই স্বীকার করিতে হইবে। সংস্কৃত কালেজের সুশিক্ষিত সুবিজ্ঞ শ্রীযুক্ত বাবু মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ শিক্ষাবিধান করিতেছেন। গবর্নমেণ্ট প্রদত্ত সম্পাদকীয় ভার শ্রীযুক্ত বাবু হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি পরম বিদ্যোৎসাহী, বিশেষতঃ স্বদেশ ভাষায় অসাধারণ জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তিনি প্রত্যহ অন্ততঃ দুই ঘটিকা পর্যন্ত প্রগাঢ় উৎসাহ সহকারে উপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন। সদুপদেশ অমূল্য অসমুদ্র-সম্ভূত রত্ন-স্বরূপ, যে প্রকার দিনকরের কর নিস্তেজ বস্তুতে প্রতিফলিত হইয়া সেই বস্তু নয়ন-প্রফুল্লকর শোভায় শোভিত হয়, তদ্রূপ সুমধুর উপদেশাবলী বালকগণের অন্তঃকরণে নীত হইয়া তাহাদিগের জ্ঞানাভাব উজ্জ্বল্য সম্পাদন করে। স্কুলের অবস্থা ক্রমে যেরূপ সমুন্নতি হইতেছে তাহাতে তত্রত্য বালকবালিকারা ভাষা শিক্ষা বিদ্যাভ্যাস প্রভৃতি উত্তরোত্তর পরিবর্ধিত হইবেক। আমরা বোধ করি অব্যাঘাতে তিন চারি বৎসর যথাবিধানে শিক্ষাকার্য সুসম্পন্ন হইলে বিদ্যালয়ের অনেকাংশে শ্রীবৃদ্ধি হইবেক। বিগত ১০ই ফিব্রুআরি তারিখে ডেপটি ইন্‌স্পেক্টার প্রশংসিত বাবু বিদ্যালয়ে আগমন ও নিয়মিতরূপে পরীক্ষা গ্রহণে প্রতিগমন করিতে করিতে ১২ই ফিব্রুআরী তারিখে প্রধান ইনস্পেক্টার শ্রীযুক্ত মেং উডরো সাহেব মহোদয় বিদ্যালয়ে উপনীত হইয়া শিক্ষা সমাজের প্রচারিত পদ্ধতিক্রমে বালক বালিকার প্রত্যেককে এক এক করিয়া পরীক্ষা লইয়া অতীব সন্তোষ জ্ঞাপন করিয়াছেন। তদনন্তর সম্পাদক বাবুর যত্নাতিশয় বশতঃ সাহেব এই পল্লীর অনতিদূরবর্তি— কাটিপাড়াস্থ গ্রাম্য স্কুল সন্দর্শন করিতে গিয়াছিলেন, তথায় চতুর্দিকে মনোহর পুষ্পোদ্যান পরিশোভিত সুখসেব্য বায়ু সেবিত সুবিস্তৃত সুসজ্জিত রমণীয় বিদ্যামন্দির দর্শন ও যথা কথঞ্চিৎ ছাত্রগণের একজামিন করিলেন। অতঃপর স্কুল সংস্থাপনকারি শ্রীযুক্ত বাবু বংশীধর ঘোষ মহাশয়ের প্রযত্ন ক্রমে এই স্কুলটি গবর্ণমেণ্টের তত্ত্বাবধারণে আনার প্রস্তাব হইয়াছে। বাবু বার্ষিক তিন শত টাকা চাঁদা দিতে সম্মত হইয়াছেন। এ প্রদেশের মধ্যে এস্থান সর্বপ্রধান, সকলে মনে করিলে যত্ন করিলে মাসিক এত চাঁদা সংগ্রহ হয় যে তদ্দ্বারা বিদ্যালয় স্কুল অথবা কালেজ সংস্থাপন ও অনায়াসে ব্যয় নিষ্পন্ন হইতে পারে, কিন্তু মনের অনৈক্যতা, ধনের উন্মত্ততা, স্ব স্ব স্বতন্ত্রতা প্রভৃতি কারণে বিঘ্ন বিঘটন করে, এইক্ষণে গবর্ণমেণ্টের যত্নবারি বিতরিত হইলে স্কুলটি চিরস্থায়ী হইতে পারে।”

 “রাডুলি অঞ্চল হইতে এক বন্ধু আমাকে জানাইয়াছেন,—হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরী কিরূপ বিদ্যোৎসাহী ও স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন একটি ঘটনা হইতে তাহা বেশ বুঝা যায়। হরিশ্চন্দ্র ১৮৫৮ সন হইতে মাঝে মাঝে কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতেন। তখন তিনি তাঁহার সহধর্মিণী ভুবনমোহিনীকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বয়ং ভূবনমোহিনীকে বাঙ্গালা পাঠ শিক্ষা করিতে সহায়তা করিতেন।

 হরিশ্চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি পরবর্তি কালে শুধু বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত হইরাছে। বিদ্যালয়টি এখন একটি দ্বিতল গৃহে অবস্থিত। হরিশ্চন্দ্রের সুযোগ্য পুত্র বিশ্ববিশ্রুত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রাডুলি অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারের জন্য বহুসহস্র টাকা দান করিয়াছেন। এই টাকার উপস্বত্বের কতক অংশ বালিকাদের শিক্ষার জন্য ব্যয়িত হইয়া থাকে। বিদ্যালয়টি এখন আচার্য রায় মহাশয়ের মাতা ভূবনমোহিনীর নামে।”