পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪
আত্মচরিত

প্রকৃতপক্ষে ইহা তাঁহার স্ত্রীধন[১] ছিল। আমাদের পরিবারের ব্যয় সঙ্কোচ করা এখন প্রয়োজন হইয়া পড়িল,—এবং ইহার ফলে আমাদের কলিকাতার বাসা উঠাইয়া লওয়া হইল। আমার পিতামাতা গ্রামের বাড়ীতে গেলেন এবং আমি ও আমার ভ্রাতৃগণ ছাত্রাবাসে আশ্রয় লইলাম।

 আমি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশানে ভর্তি হইলাম। উহার কলেজ বিভাগ নূতন খোলা হইয়াছিল। উচ্চশিক্ষা মাধ্যমিক শিক্ষার মতই সুলভ করিবার সাহসপূর্ণ চেষ্টা ভারতে এই প্রথম। স্কুল বিভাগের মত কলেজ বিভাগের ‘বেতন’ও তিনটাকা মাত্র ছিল। আমার বিদ্যাসাগরের কলেজে ভর্তি হইবার পক্ষে কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশান জাতীয় প্রতিষ্ঠান—যাহাকে আমাদের নিজস্ব বস্তু বলিয়া মনে করা যাইতে পারিত। দ্বিতীয়তঃ, এই কলেজে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি আমাদের সময়ে ছাত্রদের নিকট ‘দেবতা’ ছিলেন বলিলেই হয়) ইংরাজী গদ্য সাহিত্যের এবং প্রসন্নকুমার লাহিড়ী (প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক সেক্সপীয়র সাহিত্যে সুপণ্ডিত টনী সাহেবের প্রসিদ্ধ ছাত্র) ইংরাজী কাব্য সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। আমি কিন্তু ফার্স্ট আর্টস্ পড়িবার সময় রসায়নে এবং বি, এ, পড়িবার সময় পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন উভয় বিষয়ে, প্রেসিডেন্সী কলেজে বাহিরের ছাত্র হিসাবে অধ্যাপকদের বক্তৃতা নিতাম। এফ, এ, কোর্সে সেই সময় রসায়নশাস্ত্র অবশ্যপাঠ্য বিষয় ছিল। মিঃ (পরে স্যার আলেকজেণ্ডার) পেড্‌লার গবেষণামূলক পরীক্ষা কার্যে (Experiment) বিশেষ দক্ষ ছিলেন। আমি প্রায় নিজের অজ্ঞাতসারেই রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। ক্লাসে ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ দেখিয়া সন্তুষ্ট না হইয়া আমি এবং আমার একজন সহাধ্যায়ী বাড়ীতে একটী ছোটখাট ‘লেবরেটরী’ স্থাপন করিলাম এবং আমরা সেখানে কোন কোন ‘এক্সপেরিমেণ্টও’ করিতে লাগিলাম। একবার আমরা সাধারণ টিনের পাত দিয়া একটি oxy-hydrogen blow-pipe তৈয়ারী করিয়াছিলাম। এই স্থূল যন্ত্রদ্বারা পরীক্ষা করিতে গিয়া একদিন উহা ভীষণশব্দে ফাটিয়া গিয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমরা আহত হই নাই। রস্কোর Elementary Lessons তখন পাঠ্য থাকিলেও, আমি যতদূর সম্ভব আরও অনেকগুলি রসায়ন বিদ্যার বহি পড়িয়াছিলাম।

 রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি আমার আকর্ষণের ফলে আমি “বি” কোর্স লইলাম। বি, এ পরীক্ষায় তখন ইংরাজী অবশ্যপাঠ্য ছিল। গদ্য পাঠ্যতালিকার মধ্যে মর্লির “Burke” এবং বার্কের Reflection on the French Revolution ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় খুব পাণ্ডিত্যের সহিত চিত্তাকর্ষক করিয়া এই সব বহি পড়াইতেন।

 ছাত্র জীবনের এই সময়ে আমি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সংযত করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। কেননা অন্য অনেক প্রতিযোগী বিষয়ে আমাকে মন দিতে হইয়াছিল। আমি নিজের চেষ্টায় ল্যাটিন ও ফ্রেঞ্চ মোটামটি শিখিয়াছিলাম; সংস্কৃত কলেজ পাঠ্য হিসাবেই শিখিয়াছিলাম। এফ, এ, পরীক্ষায় রঘুবংশের প্রথম সাত সর্গ এবং ভট্টিকাব্যের প্রথম পাঁচ সর্গ পাঠ্য ছিল। একজন পণ্ডিতের সহায়তায় কালিদাসের আর একখানি অপূর্ব কাব্য “কুমারসম্ভবম্”-এরও রসাস্বাদ আমি করিয়াছিলাম। এই সময়ে আমি “গিলক্রাইষ্ট” বৃত্তি পরীক্ষা দিতে মনস্থ করিলাম। এই পরীক্ষা লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের “ম্যাট্রিকুলেশন”


  1. কমলাকর “বিবাদতাণ্ডবে” বলিয়াছেন—আইনজ্ঞেরা “স্ত্রীধন”এর অর্থ লইয়া তুমল যুদ্ধ করেন। ‘স্ত্রীধন’ সম্বন্ধে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের The Hindu Law of Marriage and Stridhana দ্রষ্টব্য।