পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৩৯

ও পদার্থবিদ্যা অধ্যাপনা করিতেন। কতকগুলি চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার্থী ভারতীর ছাত্রের সহিত আমার পরিচয় হইল। এডিনবার্গে এরূপ ছাত্রের সংখ্যা খুব কম ছিল না। মিস ই, এ, ম্যানিংও এডিনবার্গের কয়েকটী ভদ্রপরিবারের নিকট আমার জন্য পরিচয়পত্র দিয়াছিলেন। তখনকার দিনে লণ্ডনে ও বিলাতের অন্যান্য স্থানে যে সব ভারতীয় ছাত্র থাকিতেন, মিস, ই, এ, ম্যানিং তাহাদের উপকার করিবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন।

 এডিনবার্গ লণ্ডনের চারিশত মাইল উত্তরে, সতরাং লণ্ডন অপেক্ষা এখানে বেশী শীত। আমার লণ্ডনের বন্ধুরা এডিনবার্গের আবহাওয়ার কথা জানিতেন, সতরাং তাঁহারা আমার সঙ্গে প্রচুর গরম জামা প্রভৃতি দিয়াছিলেন, একটী “নিউমার্কেট” ওভারকোটও তাহার মধ্যে ছিল। এই সময়ে বিলাতী দর্জি ও পোষাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়, তাহা বেশ কৌতূহলপ্রদ। আমার সাধারণ পোষাক পরিচ্ছদের জন্য টটেনহাম কোর্ট রোডের দর্জির দোকান চার্লস বেকার এণ্ড কোম্পানীতে গেলাম। কিন্তু সান্ধ্য সম্মিলন, ডিনার, বল নাচ প্রভৃতির জন্য আমাকে বিশেষ “সুট” তৈরী করিবার পরামর্শ দেওয়া হইল। সেই কুৎসিত “টেইল-কোট” আমি কিছুতেই পছন্দ করিতে পারিলাম না। ইংরাজদের সাধারণ বুদ্ধি ও সহজজ্ঞান যথেষ্ট আছে। তৎসত্ত্বেও তাহারা এই বর্বর পোষাকের ‘ফ্যাশন’ কেন যে ত্যাগ করিতে পারে নাই, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। এ বিষয়ে তাহাদের ‘গেলিক’ ভ্রাতাগণের জিদও আশ্চর্য। সৌন্দর্যবোধের জন্য বিখ্যাত এবং চতুর্দশ লুইয়ের সময় হইতে ‘ফ্যাশনের’ পথ-প্রদর্শক ফ্রান্সের নিকট আমি এ সম্বন্ধে বেশি আশা করিয়াছিলাম। কিন্তু আমাকে নিরাশ হইতে হইল। ইংরাজেরা পোষাক পরিচ্ছদ এবং ডিনার (dinner) বিষয়ে যেভাবে ফরাসীদের অন্ধ অনুকরণ করে, তাহা আমার নিকট চিরদিনই নির্বুদ্ধিতা বলিয়া মনে হইয়াছে।

 সে যাহা হউক, এখন আমার কাহিনী বলি। চোগা ও চাপকানযুক্ত ভারতীয় লম্বা পোষাক সুপ্রসিদ্ধ রাজা রামমোহন রায় যাহা বিলাতে থাকিতে পরিতেন তাহাই ভারতীয়দের পক্ষে উপযোগী। আমাকে অক্সফোর্ড স্ট্রীটের চার্লস কীন এণ্ড কোম্পানীর দোকানে লইয়া যাওয়া হইল। বন্ধুদের নিকট ধার করিয়া একটা পোষাকের (চোগাচাপকানের) নমুনাও সঙ্গে লইলাম। দোকানে আমার গায়ের মাপ লইল এবং পোষাক তৈয়ারী হইলে পুনর্বার যাইয়া মাপ ঠিক করিয়া লইয়া আসিতে অনুরোধ করিল। পোষাক তৈরী হইলে আমাকে তাহারা সংবাদ দিল এবং দোকানে গেলাম। পোষাক পরিলে দেখা গেল যে যদিও মোটামটি গায়ে লাগিয়াছে, তবুও স্থানে স্থানে একটু ঢিলা হইয়াছে। দর্জি প্রথমে আমাকে এই ত্রুটি দেখাইয়া দিয়া কৈফিয়ৎ স্বরূপ বলিল— “মশায়, আপনি এত সরু ও পাতলা যে আপনার শরীরের জন্য মাপসই জামা করা শক্ত।” কোন কোন পাঠক হয়ত আমার এই দুর্দশায় হাসিবেন। সম্ভবতঃ আমার চেহারা অনেকটা ‘আইকাবড ক্রেনের’ মত ছিল। আমি এপিকটেটাসের শিষ্য এবং ডাইওজিনিসের অনুরাগী,—কৌপীনধারী মহাত্মা গান্ধীও আমার শ্রদ্ধার পাত্র,—অনাড়ম্বর সরল জীবন এবং জ্ঞান চর্চাই জীবনের আদর্শ, সতরাং এইরূপ লঘু বিষয়ের উল্লেখ করার জন্য পাঠকদের নিকট আমার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

 আমি আমার পাঠ্যস্থান এডিনবার্গে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৌঁছিলাম। শীতের সেসন আরম্ভ হইবার তখন কয়েকদিন বাকী আছে। এডিনবার্গ সুন্দর সহর, লণ্ডনের আকাশ যেমন কুয়াশায় আচ্ছন্ন, এস্থান তেমন নহে। গ্লাসগোর মত এখানে কলকারখানা নাই, সুতরাং ধোঁয়ার উপদ্রবও কম, রাস্তার যানবাহনের অত্যাচারও তেমন নাই। এডিনবার্গের চারিদিকেই সুন্দর দৃশ্য, এবং সমদ্র খুবে নিকটে, আমি একটি মাঠের নিকটে এবং “আর্থার্স সিট” হইতে অল্পদূরে বাসা করিলাম। ছুটীর সময়ে “আর্থার্স সিট” আমার বড় প্রিয় স্থান