পাতা:আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চুড়ায় একটি ঘর ছিল, তার দ্বারগুলি মুক্ত, সেখান থেকে দেখা যেত ঘন বকুলগাছের আগ্‌ডালের চিকন পাতায় আলোর ঝিলিমিলি। চারি দিক থেকে দুরন্ত বাতাসের লীলা সেখানে বাধা পেত না। আর ছাদের উপর থেকে মনে হত মেঘের খেলা যেন আমাদের পাশের আঙিনাতেই। এইখানে ছিল আমার বাসা, আর এইখানেই আমার মানসীকে ডাক দিয়ে বলেছিলেম―

এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার।

 সে ঘর নেই, সে বাড়ি আজ লৌহদন্তদন্তুর কলের কবলে কবলিত। সে গঙ্গা আজ অবমাননায় সংকুচিত, বন্দী হয়েছে কল-দানবের হাতে— ত্রেতাযুগে জানকী যেমন বন্দী হয়েছিলেন দশমুণ্ডের দুর্গে। দেবী আজ শৃঙ্খলিতা।

 সেদিন যে বালক জীবনের ঊষালোকে আপনাকে স্পষ্ট করে চেনে নি এবং চেনে নি এই সংসারকে, তার উপরে একে একে অন্তত পঞ্চাশ বছরের চাপ পড়েছে। এই চাপে সেই বালক সম্পূর্ণ লোপ পায় নি। আমি আজ নানা কাজে হাত দিয়েছি, এবং নানা দেশের কাছ থেকে খ্যাতি অর্জন করেছি। কিন্তু অন্তরের মধ্যে সেই বালক এখনো আছে কাঁচা― সংসারের যে হাটে সব জিনিসের দর যাচাই হয় সেখানকার রাস্তাঘাটে ও চালচলনে এখনো সে পাকা হয় নি; প্রকৃতির খেলার প্রাঙ্গণটার দিকে এখনো তার টান― তা ছাড়া খ্যাতির মধ্যে সে আপনার খাঁটি পরিচয় পায় না। খ্যাতির মতো বন্ধন নেই, দশের মুখের কথার জাল থেকে মনকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে রাখা শক্ত। বালকের মনের যে ডানা সেদিন আকাশে ছাড়া পেয়েছিল তার সঙ্গে খ্যাতির দড়ি বাঁধা ছিল না। আজো সেদিনকার সেই খ্যাতিহীন মুক্তির আকাশের জন্যে তার মন ব্যাকুল হয়। সেইজন্যেই এত করে মনে পড়ে চন্দননগরের গঙ্গার তীর, সেই মোরানের

১১৬