পাতা:আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহা পাইও নাই। আমায় যশেয় ভোজে কাজ সমাপনের বেলায় যে মধুর জুটিয়াছে, বরাবর এ রসের আয়ােজন ছিল না। যে ছন্দে যে ভাষায় একদিন কাব্যরচনা আরম্ভ করিয়াছিলাম তখনকার কালে তাহা আদর পায় নাই এবং এখনকার কালেও যে তাহা আদরের যােগ্য তাহা আমি বলিতে চাই না। কেবল আমায় বলিবার কথা এই যে, যাহা আমার তাহাই আমি অন্যকে দিয়াছিলাম— ইহার চেয়ে সহজ সুবিধার পথ আমি অবলম্বন করি নাই। অনেক সময়ে লােককে বঞ্চনা করিয়াই খুশি করা যায়— কিন্তু সেই খুশিও কিছুকাল পরে ফিরিয়া বঞ্চনা করে— সেই সুলভ খুশির দিকে লােভদৃষ্টিপাত করি নাই।

 তাহার পরে আমার রচনায় অপ্রিয় বাক্যও আমি অনেক বলিয়াছি এবং অপ্রিয় বাক্যে যাহা নগদ-বিদায় তাহাও আমাকে বার বার পিঠ পাতিয়া লইতে হইয়াছে। আপনার শক্তিতেই মানুষ আপনার সত্য উন্নতি করিতে পারে, মাগিয়া পাতিয়া কেহ কোনােদিন স্থায়ী কল্যাণ লাভ করিতে পারে না, এই নিতান্ত পুরাতন কথাটিও দুঃসহ গালি না খাইয়া বলিবার সুযােগ পাই নাই। এমন ঘটনা উপরি-উপরি অনেকবারই ঘটিল। কিন্তু যাহাকে আমি সত্য বলিয়া জানিয়াছি তাহাকে হাটে বিকাইয়া দিয়া লােকপ্রিয় হইবার চেষ্টা করি নাই। আমার দেশকে আমি অন্তরের সহিত শ্রদ্ধা করি, আমার দেশের যাহা শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাহার তুলনা আমি কোথাও দেখি নাই; এইজন্য দুর্গতির দিনের যে-কোনাে ধূলিজঞ্জাল সেই আমাদের চিরসাধনার ধনকে কিছুমাত্র আচ্ছন্ন করিয়াছে তাহার প্রতি আমি লেশমাত্র মমতা প্রকাশ করি নাই— এইখানে আমার শ্রোতা ও পাঠকদের সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে আমার মতের গুরুতর বিরোধ ঘটিয়াছে। আমি জানি, এই বিরােধ অত্যন্ত কঠিন এবং ইহার আঘাত অতিশয় মর্মান্তিক; এই অনৈক্যে বন্ধুকে শত্রু ও আত্মীয়কে পর বলিয়া আমরা কল্পনা করি। কিন্তু এরূপ আঘাত দিবার যে আঘাত

৩৭