পাতা:আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হাঁসফাঁস করতে থাকে। তাগিদ যদি আরো বাড়াও তা হলে রাগিণীটা পাগলাগারদের সদর গেটের উপর মাথা ঠুকে মারা যাবে। সজীব চোখ তো ক্যামেরা নয়, ভালো করে দেখে নিতে সে সময় নেয়। ঘণ্টায় বিশপঁচিশ মাইল দৌড়ের দেখা তার পক্ষে কুয়াশা দেখা। একদা তীর্থযাত্রা বলে সজীব পদার্থ আমাদের দেশে ছিল। ভ্রমণের পূর্ণস্বাদ নিয়ে সেটা সম্পন্ন হত। কলের গাড়ির আমলে তীর্থ রইল, যাত্রা রইল না; ভ্রমণ নেই, পৌঁছনো আছে; শিক্ষাটা বাদ দিয়ে পরীক্ষাটা পাস করা যাকে বলে। রেল-কোম্পানির কারখানায় কলে ঠাসা তীর্থযাত্রার ভিন্ন ভিন্ন দামের বটিকা সাজানো, গিলে ফেললেই হল— কিন্তু হলই না যে সে কথা বোঝবারও ফুরসুত নেই। কালিদাসের যক্ষ যদি মেঘদূতকে বরখাস্ত করে দিয়ে এরোপ্লেন-দূতকে অলকায় পাঠাতেন তা হলে অমন দুই-সর্গভরা মন্দাক্রান্তা ছন্দ দু-চারটে শ্লোক পার না হতেই অপঘাতে মরত। কলে-ঠাসা বিরহ তো আজ পর্যন্ত বাজারে নামে নি।

 মেঘদূতের সেই শোকাবহ পরিণামে শোক করবে না এমনতরো বলবান পুরুষ আজকাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এখন কবিতার যে আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে সে নাভিশ্বাসের আওয়াজ। ওর সময় হয়ে এল। যদি তা সত্য হয় তবে সেটা কবিতার দোষে নয়, সময়ের দোষে। মানুষের প্রাণটা চিরদিনই ছন্দে বাঁধা, কিন্তু তার কালটা কলের তাড়ায় সম্প্রতি ছন্দ-ভাঙা।

 আঙুরের খেতে চাষি কাঠি পুঁতে দেয়, তারই উপর আঙুর লতিয়ে উঠে আশ্রয় পায়, ফল ধরায়। তেমনি জীবনযাত্রাকে সবল ও সফল করবার জন্যে কতকগুলি রীতিনীতি বেঁধে দিতে হয়। এই রীতিনীতির অনেকগুলিই নির্জীব নীরস উপদেশ-অনুশাসনের খুঁটি। কিন্তু বেড়ায়-লাগানো জিয়ল কাঠের খুঁটি যেমন রস পেলেই বেঁচে ওঠে তেমনি জীবনযাত্রা যখন প্রাণের ছন্দে শান্তগমনে চলে তখন শুকনো খুঁটিগুলো অন্তরের

৮৭