পাতা:আধুনিক সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৬
আধুনিক সাহিত্য

কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে কখন্ যে স্থায়িত্ব লাভ করিয়াছে তাহা জানিতেও পারা যায় না। বোসেদের ফুলবাগানের মধ্যে, তালপুকুরের ধারে এই দুটি ক্ষুদ্র বালিকার সখিত্ব আমরা সস্নেহে সানন্দে নিরীক্ষণ করিতেছিলাম। তাহার মধ্যে পাঠশালার ছেলেদের দৌরাত্ম্য-কোলাহল, বালকবিদ্বেষী উত্ত্যক্ত বাগ্‌দিবুড়ির অভিশাপমন্ত্র, মধ্যাহ্নে পক্ষীনীড়লুণ্ঠক ছাত্রবৃন্দ কর্তৃক আন্দোলিত ঘন আম্রবনের ছায়া এবং নিভৃত দীর্ঘিকার সন্তরণাকুল অগাধশীতল জলের তরঙ্গভঙ্গ মিশ্রিত হইয়া একটি মনোহর সৌন্দর্য সৃষ্টি করিয়াছিল। আমরা পাঠকবর্গ ইহাতেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলাম, ইহার অধিক আর-কিছুই প্রার্থনা করি নাই। এমন সময় হরিশপুর পল্লীর সেই স্নিগ্ধ আম্রবনচ্ছায়ার মধ্যে একটুখানি অলৌকিকের ছায়া আসিয়া পড়িল; ফুল স্বপ্নে দেখিল যে, তাহার আসন্ন বিবাহ শুভ হইবে না এবং বাগ্‌দিবুড়ির মুখেও যেন সেই অভিশাপ শুনিতে পাইল, এবং বটবৃক্ষের শাখা হইতেও সেই অভিশাপ ধ্বনিত হইতে লাগিল। তখনই বুঝিলাম, ফুলকুমারীর বিবাহও সুখের হইবে না এবং পাঠকের কাব্যরস-সম্ভোগের আনন্দেও অভিশাপ লাগিয়াছে। কিছুকাল পরে ফুলকুমারীও তাহার দুঃস্বপ্ন ভুলিয়া গেল, পাঠকও পুনশ্চ ক্ষুদ্র পল্লীর লোকসমাজে প্রবেশ করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে তাহার একটা ফাঁড়া আছে।

 সেখানে প্রবেশ করিয়া নায়েব মহেশ্বর ঘোষের সহিত সাক্ষাৎ হইল। শান্তিসৌন্দর্যমগ্ন পল্লীটির মধ্যে ইনিই রুদ্ররসের অবতারণা করিয়াছেন। রৌদ্রীশক্তিতে গৃহিণী জগদ্ধাত্রী আবার স্বামীকেও অভিভূত করিয়াছেন। দেখিয়া মনে হয় যে, প্রজাবর্গ অসহায় হস্তীর ন্যায় পড়িয়া আছে; নায়েব সিংহের ন্যায় তাহাদের স্কন্ধের উপর চড়িয়া রুধির শশাষণ করিতেছেন এবং গৃহিণী জগদ্ধাত্রী, দেবীজগদ্ধাত্রীর ন্যায় এই প্রচণ্ড সিংহের স্কন্ধে পা রাখিয়া বসিয়া আছেন।

 ছেলেটির নাম পুরন্দর। যদিচ তিনিই এই গ্রন্থের নায়ক, তথাপি