পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
আনন্দমঠ

কর্‌তে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল।

 এ সকল কথা কল্যাণীর কাণে গেল—আবালবৃদ্ধবনিতা কাহারও অবিদিত ছিল না। কল্যাণী মনে মনে বলিল, “জয় জগদীশ্বর! আজি তোমার কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে। আজ আমি স্বামিসন্দর্শনে যাত্রা করিব। হে মধুসূদন! আজ আমার সহায় হও!”

 গভীর রাত্রে কল্যাণী শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া, একা খিড়কির দ্বার খুলিয়া এদিক্‌ ওদিক্ চাহিয়া, কাহাকে কোথাও না দেখিয়া, ধীরে ধীরে নিঃশব্দে গৌরীদেবীর পুরী হইতে রাজপথে নিষ্ক্রান্ত হইল। মনে মনে ইষ্টদেবতা স্মরণ করিয়া বলিল, “দেখ ঠাকুর, আজি যেন পদচিহ্নে তাঁর সাক্ষাৎ পাই।”

 কল্যাণী নগরের ঘাঁটিতে আসিয়া উপস্থিত। পাহারাওয়ালা বলিল, “কে যায়?” কল্যাণী ভীতস্বরে বলিল, “আমি স্ত্রীলোক।” পাহারাওয়ালা বলিল, “যাবার হুকুম নাই।” কথা দফাদারের কাণে গেল। দফাদার বলিল, “বাহিরে যাইবার নিষেধ নাই, ভিতরে আসিবার নিষেধ।” শুনিয়া পাহারাওয়ালা কল্যাণীকে বলিল, “যাও মায়ি, যাবার মানা নাই, লেকেন্ আজ্‌কা রাত্‌মে বড় আফ্‌ত, কেয়া জানে মায়ি তোমার কি হোবে, তুমি কি ডেকেতের হাতে গির্‌বে, কি খানায় পড়িয়া মরিয়ে যাবে, সে তো হাম্ কিছু জানে না, আজকা রাত মায়ি, তুমি বাহার না যাবে।”

 কল্যাণী বলিল, “বাবা, আমি ভিখারিণী— আমার এক কড়া কপর্দ্দক নাই, আমায় ডাকাতে কিছু বলিবে না।”

 পাহারাওয়ালা বলিল, “বয়স আছে, মায়ি বয়স আছে, দুনিয়ামে ওহি তো জেওরাত হ্যায়! বল্‌কে হামি ডেকেত হতে পারে।” কল্যাণী দেখিল বড় বিপদ্, কিছু কথা না কহিয়া, ধীরে ধীরে ঘাঁটি এড়াইয়া চলিয়া গেল। পাহারাওয়ালা দেখিল, মায়ি রসিকতাটা বুঝিল না, তখন মনের দুঃখে গাঁজায় দম মারিয়া ঝিঝিট খাম্বাজে সোরির টপ্পা ধরিল। কল্যাণী চলিয়া গেল।

 সে রাত্রে পথে দলে দলে পথিক; কেহ মার মার শব্দ করিতেছে, কেহ পালাও পালাও শব্দ করিতেছে, কেহ কান্দিতেছে, কেহ হাসিতেছে, যে যাহাকে দেখিতেছে, সে তাহাকে ধরিতে যাইতেছে। কল্যাণী অতিশয় কষ্টে পড়িল। পথ মনে নাই, কাহাকে জিজ্ঞাসা করিবার যো নাই, সকলে রণোন্মুখ। কেবল লুকাইয়া লুকাইয়া অন্ধকারে পথ চলিতে হইতেছে। লুকাইয়া লুকাইয়া যাইতেও এক দল অতি উদ্ধত উন্মত্ত বিদ্রোহীর