পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৮
আনন্দমঠ

 যেখানে হৃৎপিণ্ড, শান্তি সেইখানে হাত দিয়া দেখিল, কিছুমাত্র গতি নাই; সব শীতল।

 সেই পুরুষ আবার বলিলেন, “নাকের কাছে হাত দিয়া দেখ—কিছুমাত্র নিঃশ্বাস বহিতেছে কি?”

 শান্তি দেখিল, কিছুমাত্র না।

 সেই পুরুষ বলিলেন, “আবার দেখ, মুখের ভিতর আঙ্গুল দিয়া দেখ— কিছুমাত্র উষ্ণতা আছে কি না?” শান্তি আঙ্গুল দিয়া দেখিয়া বলিল, “বুঝিতে পারিতেছি না।” শান্তি আশামুগ্ধ হইয়াছিল।

 মহাপুরুষ, বাম হস্তে জীবানন্দের দেহ স্পর্শ করিলেন। বলিলেন, “তুমি ভয়ে হতাশ হইয়াছ! তাই বুঝিতে পারিতেছ না—শরীরে কিছু তাপ এখনও আছে বোধ হইতেছে। আবার দেখ দেখি।”

 শান্তি তখন আবার নাড়ী দেখিল, কিছু গতি আছে। বিস্মিত হইয়া হৃৎপিণ্ডের উপরে হাত রাখিল—একটু ধক্ ধক্ করিতেছে! নাকের আগে অঙ্গুলি রাখিল—একটু নিঃশ্বাস বহিতেছে। মুখের ভিতর অল্প উষ্ণতা পাওয়া গেল। শান্তি বিস্মিত হইয়া বলিল, “প্রাণ ছিল কি? না আবার আসিয়াছে?”

 তিনি বলিলেন, “তাও কি হয় মা! তুমি উহাকে বহিয়া পুষ্করিণীতে আনিতে পারিবে? আমি চিকিৎসক, উহার চিকিৎসা করিব।”

 শান্তি অনায়াসে জীবানন্দকে কোলে তুলিয়া পুকুরের দিকে লইয়া চলিল। চিকিৎসক বলিলেন, “তুমি ইহাকে পুকুরে লইয়া গিয়া, রক্তসকল ধুইয়া দাও। আমি ঔষধ লইয়া যাইতেছি।”

 শান্তি জীবানন্দকে পুষ্করিণীতীরে লইয়া গিয়া রক্ত ধৌত করিল। তখনই চিকিৎসক বন্য লতা পাতার প্রলেপ লইয়া আসিয়া সকল ক্ষতমুখে দিলেন। তার পর, বারংবার জীবানন্দের সর্বাঙ্গে হাত বুলাইলেন। তখন জীবানন্দ এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল। শান্তির মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “যুদ্ধে কার জয় হইল?”

 শান্তি বলিল, “তোমারই জয়। এই মহাত্মাকে প্রণাম কর।”

 তখন উভয়ে দেখিল, কেহ কোথাও নাই! কাহাকে প্রণাম করিবে?

 নিকটে বিজয়ী সন্তানসেনার বিষম কোলাহল শুনা যাইতেছিল, কিন্তু শান্তি বা জীবানন্দ কেহই উঠিল না—সেই পূর্ণচন্দ্রের কিরণে সমুজ্জ্বল পুষ্করিণীর সোপানে বসিয়া