পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পাঠভেদ
১৪৭

 শান্তি। তুমি ভল্লুক হে।

 জীব। তুমি উল্লুক, অর্ব্বাচীন, নাস্তিক, বিধর্ম্মী, ভণ্ড, পামর!

 শান্তি। তুমি—যলায়বায়াবোচীচঃ—তুমি—স্তুশ্চুভিশ্চশাৎ—তুমি ষ্টুভিষ্ট্বষ্যাদান্তটোঃ।

 জীব। বের শালা এখান থেকে—তোর দাড়ি ছিঁড়িব।

 শান্তি তখন গণিল প্রমাদ! দাড়ি ধরিলেই মুস্কিল। পরচুলো খসিয়া পড়িবে। শান্তি সহসা রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়নে তৎপর হইল।

 জীবানন্দ পিছু পিছু ছুটিল। মনে মনে ইচ্ছা, ভণ্ডটা মঠের বাহিরে গেলে দুই ঘা দিব। শান্তি যাই হউক স্ত্রীলোক—দৌড়ধাপে অনভ্যস্ত। জীবানন্দ এ সকল কাজে সুশিক্ষিত। শীঘ্র গিয়া শান্তিকে ধরিল। এবং তাহাকে ভূতলে ফেলিয়া প্রহার করিবে বলিয়া তাহাকে কায়দা করিয়া জাপটাইয়া ধরিতে গেল। স্পর্শ মাত্রেই জীবানন্দ চমকিয়া শান্তিকে ছাড়িয়া দিল। কিন্তু শান্তি বাহু দ্বারা জীবানন্দের গলা জড়াইয়া ধরিল।

 জীবানন্দ বলিল, “এ কি! তুমি যে স্ত্রীলোক! ছাড়! ছাড়! ছাড়!” কিন্তু শান্তি সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, “ওগো, তোমরা দেখ গো! এক জন গোঁসাই জোর করিয়া স্ত্রীলোকের সতীত্ব নষ্ট করিতেছে।”

 জীবানন্দ তাহার মুখে হাত দিয়া বলিল, “সর্ব্বনাশ! সর্ব্বনাশ! অমন কথা মুখে এনো না। ছাড়! ছাড়! আমার ঘাট হয়েছে, ছাড়!”

 শান্তি ছাড়ে না; আরও চেঁচায়, শান্তির কাছে জোর করিয়া ছাড়ানও সহজ নয়। জীবানন্দ যোড়হাত করিয়া বলিতে লাগিল, “তোমার পায়ে পড়ি, ছাড়!” শেষে স্ত্রীলোকের আর্ত্তনাদে অরণ্য পরিপূরিত হইয়া গেল।

 এ দিকে মঠের গোঁসাইরা স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচার হইতেছে শুনিয়া, অনেকে ধুনুচির ভিতর প্রদীপ জ্বালিয়া লাঠি সোঁটা লইয়া বাহির হইলেন। দেখিয়া জীবানন্দ থর থর কাঁপিতে লাগিল। শান্তি বলিল, “অত কাঁপিতেছ কেন? তুমি ত বড় ভীত পুরুষ! আবার লোকে তোমাকে বলে মহাবীর?”

 গোঁসাইরা আলো লইয়া নিকটবর্ত্তী হইল দেখিয়। জীবানন্দ সকাতরে বলিলেন, “আমি অতিশয় কাপুরুষ, তুমি আমায় ছাড়, আমি পলাই।”

 শান্তি। জোর করিয়া ছাড়াও না।

 জীবানন্দ লজ্জায় স্বীকার করিতে পারিলেন না যে, তিনি স্ত্রীলোকের জোরে পারিতেছেন না। বলিলেন,

 “তুমি বড় পাপিষ্ঠা।”

 শান্তি তখন মুচকি হাসিয়া, বিলোল কটাক্ষ ক্ষেপণ করিয়া বলিল,

 “প্রাণাধিক! আমি তোমার প্রতি অতিশয় আসক্ত। তোমার দাসী হইব বলিয়াই এখানে আসিয়াছি, আমায় গ্রহণ করিবে, স্বীকার কর, ছাড়িয়া দিতেছি।”