পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

৷৶৹

নাট্যশালা, কাছারি, দৈনিক জীবন ও চিন্তা, মন্দির ও গৃহ নির্ম্মাণ প্রভৃতি বিষয়ে পণ্ডিতদের লেখা অনেক অনেক পুস্তক পড়িয়া এগুলির বিস্তৃত অতি নিখুঁৎ চিত্র আঁকিয়াছিলেন, যেন সেই যুগে সেই শহরের কতকগুলি ফোটোগ্রাফ দিয়াছেন। লীটনের নভেলখানিতে বাহ্য পরিচ্ছদ ঠিক আছে, অবিকল সত্য; কিন্তু উহার মধ্যে প্রাণ কই? উহার মধ্যকার মানবচরিত্রগুলি চিরস্মরণীয় হইয়া থাকে নাই কেন? সমালোচক মেকলে ঠিক বলিয়াছেন যে, এডিসনের মত পণ্ডিত ক্লাসিকালু স্কলারের রচিত কেটো নাটকের মহাসম্ভ্রান্ত রোমান্ সিনেটর অপেক্ষা স্কটের উপন্যাসে বর্ণিত বর্ব্বর দরিদ্র ডাকাত মস্টরুপার্ অনেক বড় কারণ অধিকতর জীবন্ত, অধিকতর বাস্তব। এই পরীক্ষায় বঙ্কিমের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি অপরাজিত, সাহিত্য সর্ব্বপ্রথম পদ অধিকার করিয়াছে।

 বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র প্রথা লীটনের পন্থার বিপরীত। প্রথমেই তো গোড়ায় গলদ; তাহার ‘সন্তানেরা’ বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ কায়স্থের ছেলে, গীতা যোগশাস্ত্র প্রভৃতিতে পণ্ডিত; কিন্তু যে সব “সন্ন্যাসী ফকিরেরা” সত্য ইতিহাসের লোক, এবং উত্তরবঙ্গে (বীরভূম নহে) ঐ সব অত্যাচার করে তাহারা এলাহাবাদ কাশী ভোজপুর প্রভৃতি জেলার পশ্চিমে লোক এবং প্রায় সকলেই নিরক্ষর, ভগবদ্গীতার নাম পর্য্যন্ত জানিত না। বঙ্কিমের সন্তানসেনা বৈষ্ণব, আর আসল “সন্ন্যাসী”রা ছিল শৈব, আজ পর্যন্ত তাহাদের নাগা-সম্প্রদায় চলিয়া আসিতেছে, যদিও ইংরেজের ভয়ে তাহারা এখন অস্ত্র রাখিতে বা লুঠ করিতে পারে না। এই সব সন্ন্যাসী গোঁসাই যোদ্ধাদের প্রকৃত ইতিহাস “রাজেন্দ্রগিরি গোঁসাই” (মৃত্যু দিল্লীর বাহিরে যুদ্ধে, ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দে) এবং তাহার চেলা “হিম্মৎ বাহাদুর” সম্বন্ধে রচিত ফারসী গ্রন্থ এবং হিন্দী “হিম্মৎ বাহাদুর বিরুদাবলী” প্রভৃতিতে পাওয়া যায়। বাঙ্গলার বিপ্লবকারী সন্ন্যাসীদের অতি মূল্যবান সত্য বিবরণ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার Dawn of New India (1927)তে এবং রায় সাহেব যামিনীমোহন ঘোষ তাঁহার Sannyasi Fakir Raiders of Bengal গ্রন্থে (Bengal Secretariat Book Depot, 1930) দিয়াছেন। পাঠক উৎসুক হইলে এ দুইখানি ইতিহাস পড়িবেন।

 সত্যকার সন্ন্যাসী ফকিরেরা অর্থাৎ পশ্চিমে গিরিপুরীর দল, একেবারে লুঠেড়া ছিল, কেহ কেহ অযোধ্যা সুবায় জমিদারিও করিত; মাতৃভূমির উদ্ধার, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন উহাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল, এই মহাব্রত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কল্পনায় সৃষ্ট কুয়াশা মাত্র। সুতরাং ইতিহাসের দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে ‘আনন্দমঠে’ বর্ণিত নরনারী