পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
(সম্পাদকীয়)

 ‘আনন্দমঠে’র ঐতিহাসিকত্ব সম্বন্ধে স্যার যদুনাথ সরকার লিখিত একটি ভূমিকা এই গ্রন্থমধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। ইতিহাসের দিক্ দিয়া ‘আনন্দমঠ'-সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য ঐ ভূমিকায় দেওয়া হইয়াছে। 'দেবী চৌধুরাণী’র' “বিজ্ঞাপনে” (১৮৮৪ খ্রীঃ) স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠে’র ঐতিহাসিকত্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহাও স্মরণীয়।

 “আনন্দমঠ” প্রকাশিত হইলে পর, অনেকে জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, ঐ গ্রন্থের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না। সন্ন্যাসী-বিদ্রোহ ঐতিহাসিক বটে, কিন্তু পাঠককে সে কথা জানাইবার বিশেষ প্রয়োজনের অভাব। এই বিবেচনায় আমি সে পরিচয় কিছুই দিই নাই। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভাণ করি নাই। এক্ষণে দেখিয়া শুনিয়া ইচ্ছা হইয়াছে, আনন্দমঠের ভবিষ্যৎ সংস্করণে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কিঞ্চিৎ ঐতিহাসিক পরিচয় দিব।—পাঠক মহাশয়, অনুগ্রহ-পূর্ব্বক আনন্দমঠকে—"ঐতিহাসিক উপন্যাস” বিবেচনা না করিলে বড় বাধিত হইব।

 ‘আনন্দমঠে’র তৃতীয় সংস্করণের (১৮৮৬ খ্রীঃ) দুইটি Appendix-এ Gleig's Memoirs of the Life of Warren Hastings এবং Hunters Annals of Rural Bengal হইতে বঙ্কিমচন্দ্র সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের কিঞ্চিৎ “ঐতিহাসিক পরিচয়” দিয়াছেন।

 ইতিহাস ছাড়াও অন্য নানা কারণে ‘আনন্দমঠে'র প্রসিদ্ধি। এই উপন্যাস এবং ইহার অন্তর্গত 'বন্দে মাতরম্' সঙ্গীত সম্বন্ধে স্বদেশে ও বিদেশে যত আলোচনা হইয়াছে, বঙ্কিমচন্দ্রের অন্য কোনও রচনা লইয়া তত আলোচনা হয় নাই। পরবর্ত্তী কালে বঙ্গদেশে এবং পরে সমগ্র ভারতবর্ষে যে স্বদেশী-আন্দোলনের বন্যা দেশের আপামরসাধারণকে চঞ্চল এবং শাসক-সম্প্রদায়কে ব্যতিব্যস্ত করিয়াছিল, সরকারী এবং বেসরকারী সকল সমালোচক, সন্তান-বিদ্রোহের সহিত তাহার যোগসূত্র খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন; এই কারণে ‘আনন্দমঠ' ও 'বন্দে মাতরমে’র কম দুর্গতি হয় নাই। ক্ষুব্ধ মুসলমানসম্প্রদায় এই পুস্তকে ইসলাম-বিবোধিতা এবং উক্ত সঙ্গীতে পৌত্তলিকতা প্রত্যক্ষ করিয়া বিরুদ্ধ আন্দোলন করিয়াছেন; এই আন্দোলনের শেষ এখনও হয় নাই।

 সাহিত্য ও সমাজের দিক দিয়াও বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার পূর্ববর্ত্তী উপন্যাসের ধারা ত্যাগ করিয়া 'আনন্দমঠে’ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ ধরিয়াছেন; এখানে তাঁহার সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক হইয়া।