পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম খণ্ড—একাদশ পরিচ্ছেদ
২৯

কোথা হইতে সামান্য আলো আসিতেছিল। সেই ক্ষীপালোকে এক কালীমূর্ত্তি দেখিতে পাইলেন।

 ব্রহ্মচারী বলিলেন,

 “দেখ, মা যা হইয়াছেন।”

 মহেন্দ্র সভয়ে বলিল, “কালী।”

 ব্র। কালী—অন্ধকারসমাচ্ছন্ন কালিমাময়ী। হৃতসর্ব, এই জন্য নয়িকা। আজি দেশে সর্বত্রই শ্মশান—তাই মা কঙ্কালমালিনী। আপনার শিব আপনার পদতলে দলিতেছেন—হায় মা।

 ব্রহ্মচারীর চক্ষে দর দর ধারা পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাতে ধেটক খর্পর কেন?”

 ব্রহ্ম। আমরা সন্তান, অস্ত্র মার হাতে এই দিয়াছি মাত্র-বল, বন্দে মাতরম্।

  “বন্দে মাতরম্‌” বলিয়া মহেন্দ্র কালীকে প্রণাম করিল। তখন ব্রহ্মচারী বলিলেন, “এই পথে আইস।” এই বলিয়া তিনি দ্বিতীয় সুরঙ্গ আবোহণ করিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহাদিগের চক্ষে প্রাতঃসূর্যের রশ্মিরাশি প্রভাসিত হইল। চারিদিক হইতে মধুকণ্ঠ পক্ষিকুল গায়িয়া উঠিল। দেখিলেন, এক মর্ম্মরপ্রস্তরনির্মিত প্রশস্ত, মন্দিরের মধ্যে সুবর্ণনির্মিতা দশভুজা প্রতিমা নবারুণকিরণে জ্যোতির্ময়ী হইয়া হাসিতেছে। ব্রহ্মচারী প্রণাম করিয়া বলিলেন,—

  “এই মা যা হইবেন। দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত,—তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীর কেশরী শত্রুনিপীড়নে নিযুক্ত। দিগভুজা—” বলিতে বলিতে সত্যানন্দ গদগদকণ্ঠে কঁদিতে লাগিলেন। “দিগভুজা নানাপ্রহরণধারিণী শত্রুবিমর্দিনী-বীরেন্দ্র-পৃষ্ঠবিহারিণী-দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী-বামে বাণী বিদ্যা-বিজ্ঞানদায়িনী—সঙ্গে বলরূপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ; এস, আমরা মাকে উভয়ে প্রণাম করি।” তখন দুই জনে যুক্তকরে উর্ধমুখে এককণ্ঠে ডাকিতে লাগিল,

“সর্বমঙ্গল-মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ-সাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহও তে”

 উভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া গাজোখান করিলে, মহেন্দ্র গদগদকতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মার এ মূর্তি কবে দেখিতে পাইব?”