পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম খণ্ড—দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
৩৩

 ক। কেন?

 মহে। তোমাকে হারাইলে পর আমার যাহা যাহা ঘটিয়াছিল শুন। এই বলিয়া। যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, মহেন্দ্র তাহা সবিস্তারে বলিলেন।

 কল্যাণী বলিলেন, “আমারও অনেক কষ্ট, অনেক বিপ গিয়াছে। তুমি শুনিয়া কি করিবে? অতিশয় বিপদেও আমার কেমন করে ঘুম আসিয়াছিল, বলিতে পারি না—কিন্তু আমি কাল শেষ রাত্রে ঘুমাইয়াছিলাম। ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। দেখিলাম—কি পুণ্যবলে বলিতে পারি না—আমি এক অপূৰ্ব স্থানে গিয়াছি। সেখানে মাটি নাই। কেবল আলল, অতি শীতল মেঘভাঙ্গা আলোর মত বড় মধুর আলো। সেখানে মনুষ্য নাই, কেবল আলোময় মূর্তি, সেখানে শব্দ নাই, কেবল অতিদূরে যেন কি মধুর গীতবাদ্য হইতেছে, এমনি একটা শব্দ। সর্বদা যেন নূতন ফুটিয়াছে, এমনি লক্ষ লক্ষ মল্লিকা, মালতী, গন্ধরাজের গন্ধ। সেখানে যেন সকলের উপরে সকলের দর্শনীয় স্থানে কে বসিয়া আছেন, যেন নীল পর্বত অগ্নিপ্রভ হইয়া ভিতরে মন্দ মন্দ জ্বলিতেছে। অগ্নিময় বৃহৎ কিরীট তাহার মাথায়। তার যেন চারি হাত। তার দুই দিকে কি আমি চিনিতে পারিলাম না—বোধ হয় স্ত্রীমূর্তি, কিন্তু এত রূপ, এত জ্যোতিঃ, এত সৌরভ যে, আমি সে দিকে চাহিলেই বিহবল হইতে লাগিলাম; চাহিতে পারিলাম না, দেখিতে পারিলাম না যে কে। যেন সেই চতুর্ভুজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আর এক স্ত্রীমূর্তি। সেও জ্যোতির্ময়ী; কিন্তু চারি দিকে মেঘ, আভা ভাল বাহির হইতেছে না, অস্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, অতি শীর্ণা, কিন্তু অতি রূপবতী মর্মপীড়িত কোন স্ত্রীমূর্তি কঁদিতেছে। আমাকে যেন সুগন্ধ মন পবন বহিয়া বহিয়া, ঢেউ দিতে দিতে, সেই চতুর্ভুজের সিংহাসনতলে আনিয়া ফেলিল। যেন সেই মেঘমণ্ডিতা শীর্ণা স্ত্রী আমাকে দেখাইয়া বলিল, এই সে-ইহারই জন্য মহেন্দ্র আমার কোলে আসে না। তখন যেন এক অতি পরিষ্কার সুমধুর বাঁশীর শব্দের মত শব্দ হইল। সেই চতুর্ভুজ যেন আমাকে বলিলেন, “তুমি স্বামীকে ছাড়িয়া আমার কাছে এস। এই তোমাদের মা, তোমার স্বামী এঁর সেবা করিবে। তুমি স্বামীর কাছে থাকিলে এর সেবা হইবে না; তুমি চলিয়া আইস।’—আমি যেন কঁদিয়া বলিলাম, স্বামী ছাড়িয়া আসিব কি প্রকারে। তখন আবার বাঁশীর শব্দে শব্দ হইল, ‘আমি স্বামী, আমি মাতা, আমি পিতা, আমি পুত্র, আমি কন্যা, আমার কাছে এস। আমি কি বলিলাম মনে নাই। আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।” এই বলিয়া কল্যাণী নীরব হইয়া রহিলেন।