পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম খণ্ড-পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
৪৭

আমায় মেরে ফেল, তবে তুমি যাও। বউয়ের সঙ্গে না দেখা করে তুমি যেতে পারবে না।”

 জীবানন্দ বলিল, “আমি কত লোক মারিয়া ফেলিয়াছি, তা তুই জানিস্?”

 এইবার নিমি রাগ করিল, বলিল, “বড় কীর্ত্তিই করেছ—স্ত্রী ত্যাগ করবে, লোক মারবে, আমি তোমায় ভয় করবো! তুমিও যে বাপের সস্তান, আমিও সেই বাপের সস্তান—লোক মারা যদি বড়াইয়ের কথা হয়, আমায় মেরে বড়াই কর।”

 জীবানন্দ হাসিল, “ডেকে নিয়ে আয়—কোন পাপিষ্ঠাকে ডেকে নিয়ে আস্বি নিয়ে আয়, কিন্তু দেখ, ফের যদি এমন কথা বলবি, তোকে কিছু বলি না বলি, সেই শালার ভাই শালাকে মাথা মুড়াইয়া দিয়া ঘোল ঢেলে উল্টা গাধায় চড়িয়ে দেশের বার করে দিব।”

 নিমি মনে মনে বলিল, “আমিও তা হলে র্বাচি।” এই বলিয়া হাসিতে হাসিতে নিমি বাহির হইয়া গেল, নিকটবর্ত্তী এক পর্ণকুটীরে গিয়া প্রবেশ করিল। কুটারমধ্যে শতগ্রস্থিযুক্ত বসনপরিধান রুক্ষকেশ এক স্ত্রীলোক বসিয়া চরকা কাটিতেছিল। নিমাই গিয়া বলিল, “বউ শিগগির, শিগগির” বউ বলিল, “শিগগির কি লে। ঠাকুরজামাই তোকে মেরেছে নাকি, ঘায়ে তেল মাখিয়ে দিতে হবে?”, -

 নিমি। কাছাকাছি বটে, তেল আছে ঘরে?

 সে স্ত্রীলোক তৈলের ভাণ্ড বাহির করিয়া দিল। নিমাই ভাণ্ড হইতে তাড়াতাড়ি অঞ্জলি অঞ্জলি তৈল লইয়া সেই স্ত্রীলোকের মাথায় মাখাইয়া দিল। তাড়াতাড়ি একটা চলনসই খোপা বাধিয়া দিল। তার পর তাহাকে এক কীল মারিয়া বলিল, “তোর সেই ঢাকাই কোথা আছে বল।” সে স্ত্রীলোক কিছু বিস্মিত হইয়া বলিল, “কি লো, তুই কি খেপেছিস্ না কি?”

 নিমাই দুম করিয়া তাহার পিঠে এক কীল মারিল, বলিল, “শাড়ী বের কর।”

 রঙ্গ দেখিবার জন্য সে স্ত্রীলোক শাড়ীখানি বাহির করিল। রঙ্গ দেখিবার জন্ত, কেন না, এত দুঃখেও রঙ্গ দেখিবার যে বৃত্তি, তাহা তাহার হৃদয়ে লুপ্ত হয় নাই। নবীন যৌবন; ফুল্লকমলতুল্য তাহার নববয়সের সৌন্দর্য্য; তৈল নাই,—বেশ নাই—আহার নাই—তবু সেই প্রদীপ্ত, অননুমেয় সৌন্দর্য্য সেই শতগ্রন্থিযুক্ত বসনমধ্যেও প্রফুটিত। বর্ণে ছায়ালোকের চাঞ্চল্য, নয়নে কটাক্ষ, অধরে হাসি, হৃদয়ে ধৈর্য্য। আহার নাই—তবু শরীর লাবণ্যময়, বেশভূষা নাই, তবু সে সৌন্দর্য্য সম্পূর্ণ অভিব্যক্ত। যেমন মেঘমধ্যে বিহ্যৎ, যেমন মনোমধ্যে প্রতিভা, যেমন জগতের শব্দমধ্যে সঙ্গীত, যেমন মরণের ভিতর