পাতা:আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা - প্রবীর ঘোষ.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আইনস্টাইনের বিশাল মনীর সঙ্গে সুসমঞ্জসভাবে জড়িয়ে ছিল এক মানবতাবাদী, মুক্ত মনন। ধর্মের যে সব স্থূল দিকগুলো মানুষকে চোখ রাঙিয়ে আনুগত্য শেখায়, তাকে তিনি বলেন ‘রিলিজিয়ন অফ ফিয়ার। এবং তাকে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে ঘৃণা করতেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পুরোহিততন্ত্রকে চূড়ান্ত অপছন্দ করতেন। একইভাবে অপছন্দ করতেন লাভ-ক্ষতি-নরকভীতি থেকে উৎসারিত ধর্মভীরুতা। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নিজস্ব বিশ্বাস, প্রথা, আচার-আচরণগত ঐতিহ্য থাকে, সে বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ধর্মীয় "সম্প্রদায়গত ঐতিহ্যগুলোকে আমি শুধু ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বের দিক থেকেই গুরুত্ব দিতে পারি; এসবের আর কোনও গুরুত্ব আমার কাছে নেই।” [আইডিয়াস্ অ্যাণ্ড ওপিনিয়নস, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২৬২|

 যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলো ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ধকারকে আক্রমণ করলেই ধর্মীয় শিবির সেই আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জবাব না দিয়ে পালাবার ফিকির খোঁজে। বিজ্ঞান এখনও যে সব বিষয়ে জানতে পারেনি, সেদিকে আঙুল দেখায়। বিজ্ঞানের ও যুক্তির আলো থেকে ধর্মের এই ক্রমাগত অন্ধকারে পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাবকে আইনস্টাইন কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর কথায়, "কিন্তু আমি বুঝি যে, ধর্মীয় প্রতিনিধিদের তরফ থেকে এমন ব্যবহার শুধু যে অপদার্থতা, তা নয়, উপরন্তু মারাত্মক। কারণ একটি মতবাদ যা নিজেকে পরিস্কার আলোর মধ্যে বাঁচাতে না পেরে কেবলই অন্ধকারে গিয়ে লুকোয়, তা নিশ্চিতভাবে মানবপ্রগতির গণনাতীত ক্ষতি করে" [ঐ গ্রন্থেরই পৃষ্ঠা ৪৮|

 একজন মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পক্ষে ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা যে অনেক জরুরি, এ বিষয়ে স্পষ্ট অভিমত তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর কথায়, "একজন মানুষের নৈতিক আচার-ব্যবহারের ভিত্তি হওয়া উচিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি, শিক্ষা এবং সামাজিক বন্ধন বা সামাজিক দায়বদ্ধতা: কোনও ধর্মীয় ভিত্তির প্রয়োজন নেই। মানুষকে সংযত করার জন্য যদি তাকে শাস্তির ভয় দেখতে হয়, বা মৃত্যুর পরেব পুরস্কারের লোভ দেখাতে হয়, তাহলে মানুষের কাছে তা হলে লজ্জার ব্যাপার।” [ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৩৯|

 আইনস্টাইন ধর্মীয় দর্শনকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছিলেন। এক: ‘রিলিজিয়ন অফ ফিয়ার' বা ভয়ের ধর্ম: যে বিষয়ে তাঁর মনোভাব আগেই জানিয়েছি। দুই: 'মরাল রিলিজিয়ন' বা ধর্মের নৈতিকতা: যে বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্ট—মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা-সামাজিক দায়বদ্ধতা—সহানুভূতির ভূমিকা প্রবল। ধর্মের অনুশাসনের নামে ভয় বা লোভ মানুষকে মানুষ করে তোলে না। যা নিয়ে উপরের পংক্তিতেই আলোচনা করেছি। তিন: ‘কসমিক রিলিজিয়ন' বা মহাজাগতিক ধর্ম। এই ধর্ম ছিল তাঁর কাছে একান্তই এক বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত আবেগ; যে বিজ্ঞানী মহাজগতের জটিলতা,

৫৬