পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জানে না ইহার বৈচিত্র্য। দূরপ্রবাসে আত্মীয়স্বজনশূন্য স্থানে দীর্ঘদিন যে বাস করিয়াছে, সে জানে বাংলা দেশের জন্য, বাঙালির জন্য, নিজের গ্রামের জন্য, দেশের প্রিয় আত্মীয়স্বজনের জন্য মন কি রকম হু-হু করে, অতি তুচ্ছ পুরাতন ঘটনাও তখন অপূর্ব বলিয়া মনে হয়-মনে হয় যাহা হইয়া গিয়াছে, জীবনে আর তাহা হইবার নহে-পৃথিবী উদাস হইয়া যায়, বাংলা দেশের প্রত্যেক জিনিসটা অত্যন্ত প্রিয় হইয়া ওঠে।

 এখানে বছরের পর বছর কাটাইয়া আমারও ঠিক সেই অবস্থা ঘটিয়াছে। কতবার সদরে ছুটির জন্য চিঠি লিখিব ভাবিয়াছি, কিন্তু কাজ এত বেশি সব সময়েই হাতে আছে যে, ছুটি চাহিতে সঙ্কোচ বোধ হয়। অথচ এই জনশূন্য পাহাড়-জঙ্গলে, বাঘ ভালুক, নীলগাইয়ের দেশে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একা কাটানো যে কি কষ্ট! প্রায় হাঁপাইয়া ওঠে এক-এক সময়। বাংলা দেশ ভুলিয়া গিয়াছি, কতকাল দুর্গোৎসব দেখি নাই, চড়কের ঢাক শুনি নাই, দেবালয়ের ধুনাগুগ্‌গুলের সৌরভ পাই নাই, বৈশাখী প্রভাতে পাখির কলকূজন উপভোগ করি নাই- বাংলার গৃহস্থালির যে শান্ত পূত ঘরকন্না জলচৌকিতে পিতল-কাঁসার তৈজসপত্র, পিঁড়িতে আলপনা, কুলঙ্গীতে লক্ষ্মীর কড়ির চুপড়ি-সে সব যেন বিস্মৃত অতীত এক জীবন-স্বপ্ন।

 শীত গিয়া যখন বসন্ত পড়িয়াছে, তখন আমার এই ভাবটা অত্যন্ত বেশি বাড়িল।

 সেই অবস্থায় ঘোড়ায় চড়িয়া সরস্বতী কুণ্ডীর ওদিকে বেড়াইতে গেলাম। একটা নিচু উপত্যকায় ঘোড়া হইতে নামিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইলাম। আমার চারিদিক ঘিরিয়া উঁচু মাটির পাড়, তাহার উপর দীর্ঘ কাশ ও বনঝাউয়ের ঘন জঙ্গল। ঠিক আমার মাথার উপরে খানিকটা নীল আকাশ। একটা কণ্টকময় গাছে বেগুনি রঙের ঝাড় ঝাড় ফুল ফুটিয়াছে, বিলাতি কর্নফ্লাওয়ার ফুলের মতো দেখিতে। একটা ফুলের বিশেষ কোনো শোভা নাই, অজস্র ফুল একত্র দলবদ্ধ হইয়া অনেকখানি জায়গা জুড়িয়া দেখাইতেছে ঠিক বেগুনি রঙের একখানি শাড়ির মতন। বর্ণহীন, বৈচিত্র্যহীন অর্ধশুষ্ক কাশ-জঙ্গলের তলায় ইহারা খানিকটা