পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

 আশা পাওয়ার কথা সত্য নয়, কিন্তু অবিনাশ বড়লোকের ছেলে, মস্তবড় এস্টেট ওদের। তাহার কাছে চাকুরির উমেদারি করিতেছি এটা না-দেখায়, তাই কথাটা বলিলাম।

 অবিনাশ একটুখানি ভাবিয়া বলিল-তোমার মতো একজন উপযুক্ত লোকের চাকুরি পেতে দেরি হবে না অবিশ্যি। আমার একটা কথা আছে, তুমি তো আইনও পড়েছিলে-না?

 বলিলাম-পাশও করেছি, কিন্তু ওকালতি করবার মতিগতি নেই।

 অবিনাশ বলিল-আমাদের একটা জঙ্গল-মহাল আছে পূর্ণিয়া জেলায়। প্রায় বিশ-ত্রিশ হাজার বিঘে জমি। আমাদের সেখানে নায়েব আছে কিন্তু তার ওপর বিশ্বাস করে অত জমি বন্দোবস্তের ভার দেওয়া চলে না। আমরা একজন উপযুক্ত লোক খুঁজছি। তুমি যাবে?

 কান অনেক সময় মানুষকে প্রবঞ্চনা করে জানিতাম। অবিনাশ বলে কি! যে চাকুরির খোঁজে আজ একটি বছর কলিকাতার রাস্তাঘাট চষিয়া বেড়াইতেছি, চায়ের নিমন্ত্রণে সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে সেই চাকুরির প্রস্তাব আপনা হইতেই সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল?

 তবুও মান বজায় রাখিতে হইবে। অত্যন্ত সংযমের সহিত মনের ভাব চাপিয়া উদাসীনের মতো বলিলাম-ও! আচ্ছা ভেবে বলব। কাল আছ তো?

 অবিনাশ খুব খোলাখুলি ও দিলদরিয়া মেজাজের মানুষ। বলিল- ভাবাভাবি রেখে দাও। আমি বাবাকে আজই পত্র লিখতে বসছি। আমরা একজন বিশ্বাসী লোক খুঁজছি। জমিদারির ঘুণ কর্মচারী আমরা চাই নে-কারণ তারা প্রায়ই চোর। তোমার মতো শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোকের সেখানে দরকার। জঙ্গল-মহাল আমরা নূতন প্রজার সঙ্গে বন্দোবস্ত করব। ত্রিশ হাজার বিঘের জঙ্গল। অত দায়িত্বপূর্ণ কাজ কি যার-তার হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়। তোমার সঙ্গে আজ আলাপ নয়, তোমার নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। তুমি রাজি হয়ে যাও-আমি এখুনি বাবাকে লিখে অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট লেটার আনিয়ে দিচ্ছি।

 পরদিন খুঁজিয়া হ্যারিংটন স্ট্রিট বাহির করিলাম, বন্ধুর বাড়িও বাহির করিলাম। বাড়ি খুব বড় নয়, তবে সামনে পিছনে বাগান। গেটে উইস্টারিয়া লতা, নেপালি দারোয়ান, ও পিতলের প্লেট। লাল সুরকির বাঁকা রাস্তা- রাস্তার এক ধারে সবুজ ঘাসের বন, অন্য ধারে বড় বড় মুচুকুন্দ চাঁপা ও আমগাছ। গাড়িবারান্দায় বড় একখানা মোটর গাড়ি। বড়লোকের বাড়ি নয় বলিয়া ভুল করিবার কোনো দিক হইতে কোনো উপায় নাই। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়াই বসিবার ঘর। অবিনাশ আসিয়া আদর করিয়া ঘরে বসাইল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুরাতন দিনের কথাবার্তায় আমরা দুজনেই মশগুল হইয়া গেলাম। অবিনাশের বাবা ময়মনসিংহের একজন বড় জমিদার, কিন্তু সম্প্রতি কলিকাতার বাড়িতে তাঁহারা কেহই নাই। অবিনাশের এক ভগ্নীর বিবাহ উপলক্ষে গত অগ্রহায়ণ মাসে দেশে গিয়াছিলেন- এখনো কেহই আসেন নাই। এ-কথা ও-কথার পর অবিনাশ বলিল-এখন কি করছ সত্য?

 বলিলাম-জোড়াসাঁকো স্কুলে মাস্টারি করতুম, সম্প্রতি বসেই আছি একরকম। ভাবছি, আর মাস্টারি করব না। দেখছি অন্য কোনো দিকে যদি-দু-এক জায়গায় আশাও পেয়েছি।

 আশা পাওয়ার কথা সত্য নয়, কিন্তু অবিনাশ বড়লোকের ছেলে, মস্তবড় এস্টেট ওদের। তাহার কাছে চাকুরির উমেদারি করিতেছি এটা না-দেখায়, তাই কথাটা বলিলাম।

 অবিনাশ একটুখানি ভাবিয়া বলিল-তোমার মতো একজন উপযুক্ত লোকের