পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এই সময় মাঝে মাঝে মনে হইত যে, এখানে প্রকৃতির যে-রূপ দেখিতেছি, এমনটি আর কোথাও দেখি নাই। যতদূর চোখ যায়, এসব যেন আমার, আমি এখানে একমাত্র মানুষ, আমার নির্জ্জনতা ভঙ্গ করিতে আসিবে না কেউ—মুক্ত আকাশতলে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় দূর দিগন্তের সীমারেখা পর্য্যন্ত মনকে ও কল্পনাকে প্রসারিত করিয়া দিই।

 কাছারি হইতে প্রায় এক ক্রোশ দূরে একটা নাবাল জায়গা আছে, সেখানে ক্ষুদ্র কয়েকটি পাহাড়ি ঝরনা ঝির্ ঝির্ করিয়া বহিয়া যাইতেছে, তাহার দু-পারে জলজ লিলির বন, কলিকাতার বাগানে যাহাকে বলে স্পাইডার লিলি। বন্য স্পাইডার-লিলি কখনো দেখি নাই, জানিতামও না যে, এমন নিভৃত ঝরনার উপল-বিছানো তীরে ফুটন্ত লিলি ফুলের এত শোভা হয় বা বাতাসে তাহারা এত মৃদু কোমল সুবাস বিস্তার করে। কতবার গিয়া এখানটিতে চুপ করিয়া বসিয়া আকাশ, সন্ধ্যা ও নির্জ্জনতা উপভোগ করিয়াছি।

 মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়াই। প্রথম প্রথম ভালো চড়িতে পারিতাম না, ক্রমে ভালোই শিখিলাম। শিখিয়াই বুঝিলাম জীবনে এত আনন্দ আর কিছুতেই নাই। যে কখনো এমন নির্জ্জন আকাশ-তলে দিগন্তব্যাপী বনপ্রান্তরে ইচ্ছামতো ঘোড়া ছুটাইয়া না বেড়াইয়াছে, তাহাকে বোঝানো যাইবে না সে কি আনন্দ! কাছারি হইতে দশ-পনের মাইল দূরবর্ত্তী স্থানে সার্ভে পার্টি কাজ করিতেছে, প্রায়ই আজকাল সকালে এক পেয়ালা চা খাইয়া ঘোড়ার পিঠে জিন কষিয়া সেই যে ঘোড়ায় উঠি, কোনোদিন ফিরি বৈকালে, কোনোদিন বা ফিরিবার পথে জঙ্গলের মাথার উপর নক্ষত্র ওঠে, বৃহস্পতি জ্বল্‌ জ্বল্‌ করে; জ্যোৎস্নারাতে বনপুষ্পের সুবাস জ্যোৎস্নার সহিত মেশে, শৃগালের রব প্রহর ঘোষণা করে, জঙ্গলের ঝিঁ ঝিঁ-পোকা দল বাঁধিয়া ডাকিতে থাকে।

 যে কাজে এখানে আসা তার জন্য অনেক চেষ্টা করা যাইতেছে। এত হাজার বিঘা জমি, হঠাৎ বন্দোবস্ত হওয়াও সোজা কথা নয় অবশ্য। আর