পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অধর সর্দার, অধর সর্দারের তিন জোয়ান ছেলে, ভেঁপু মালি—এরা সব খুনি আর পোলো নিয়ে বাঁধালে জলের তোড়ে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে মাছ ধরবার চেষ্টা করচে। বৃষ্টির গুঁড়ো ছাটে চারিধারে ধোঁয়া-ধোঁয়া। রামকানাইয়ের ঘরের পেছনে একটা সেঁদালি গাছে এখনো দু'এক ঝাড় ফুল দুলচে। মাঠে ঘাসের ওপর জল বেধে ছোট পুকুরের মত দেখাচ্ছে। পথে জনপ্রাণী নেই কোনো দিকে। ঘরের মধ্যে চালের ফাঁক দিয়ে একটা নতুন তেলাকুচোর লতা ঢুকেছে, নতুন পাতা গজিয়েছে তার চারু কমনীয় সবুজ ডগায়।

 —তামাক সাজি বসুন। ভিজে গিয়েচেন যে! গামছাখানা দিয়ে মুছে ফেলুন-

 —এ বর্ষায় তিন দিন আজ বাড়ি বসে। একটু সৎ চর্চা করি এমন লোক এ গাঁয়ে নেই—সবাই ঘোর বৈষয়িক। তাই আপনার কাছে এলাম।

 —আমার কত বড় ভাগ্যি জামাইবাবু। দুটো চিঁড়ে খাবেন, দেবো? গুড় আছে কিন্তু।

 —আপনি যদি খান তবে খাবো।

 —দুজনেই খাবো, ভাববেন না। অতিথি এলেন ঘরে, দেবার কি আছে, কিছুই নেই। যা আছে তাই দেলাম। শিশিনিতি একটু গাওয়া ঘি আছে, মেখে দেবো?

 —দেখি, আপনি কিনেচেন না নিজে করেন?

 রামকানাই একটা ছোট্ট শিশি কাঠের জলচৌকি থেকে নিয়ে ভবানীর হাতে দিলেন। বললেন—নিজে তৈরি করি। গয়া মেম একটু ক’রে দুধ দেয়, আমারে বাবা বলে। মেয়েডা ভালো। সেই মেয়ে এই শিশিনি এনে দিয়েচে সায়েবদের কুঠি থেকে। যে সরটুকু পড়ে, তাই জমিয়ে ঘি করি। ঘি আমাদের ওষুধে লাগে কিনা। অনেকে গব্যঘৃত না মিশিয়ে বাজারের ভয়সা ঘি মেশায়—সেটা হোলো মিথ্যে আচরণ। জীবন নিয়ে যেখানে কারবার, সেখানে শঠতা, প্রবঞ্চনা যারা করে, তারা তেনার কাছে জবাবদিহি দেবে একদিন কি ক’রে?

 —আর কবিরাজ মশাই! দুনিয়াটা চলচে শঠতা আর প্রবঞ্চনার ওপরে।

১৬৭