পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শ্বশুর শাশুড়ী বা আর কাউকেও তেমন মানে না। সুন্দরী এক সময়ে বেশ ভালোই ছিল, এখন যৌবন সামান্য একটু পশ্চিমে হেলে পড়েছে।

 ভবানীর বড় মমতা হয়। প্রাণের শক্তিতে শক্তিময়ী মেয়ে, কত কুৎসা, কত বটনাই এর নামে। বাংলাদেশের এই পল্লী অঞ্চল যেন ক্লীবের জগৎ-সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, শক্তিমতী মেয়ে যে সৃষ্টির কি অপূর্ব বস্তু, মূর্খের ক্লীবের দল তার কি জানে? সমাজ সমাজ করেই গেল এ মহা-মূর্খের দল।

 দেখেছিলেন এদেশে এই নিস্তারিণীকে আর গয়ামেমকে। ওই আর একটি শক্ত মেয়ে। জীবন-সাধনার বড় অভিজ্ঞান ওর চরিত্র।

 রামকানাই কবিরাজের কাছে গয়ার কথা শুনেছিলেন ভবানী। নীলকুঠির বড় সাহেবের মৃত্যুর পরে রোজ সে রামকানাই কবিরাজের বাড়ি এসে চৈতন্যচরিতামৃত শুনতো; পরের দুঃখ দেখলে সিকিটা, কাপড়খানা, কখনো এক খুঁচি চাল দিয়ে সাহায্য করতো। কত লোক প্রলোভন দেখিয়েছিল,তাতে সে ভোলে নি। সব প্রলোভনকে তুচ্ছ করেছিল নিজের মনের জোরে। বড় নাকি দুরবস্থাতে পড়েছিল, গ্রামে ওর জাতের লোক ওকে একঘরে করেছিল ওর মুরুব্বী বড় সাহেব মারা যাওয়ার পর—অথচ তারাই এক কালে কত খোশামোদ করেছিল ওকে, যখন ওর এক কথায় নতুন দাগ-মারা জমির নীলের মার্কা উঠে যেতে পারতো কিংবা কুঠিতে ঘাস কাটার চাকরি পাওয়া যেতো। কাপুরুষের দল!


 সন্ধ্যার সময় খেপীর আশ্রমে গিয়ে বসলেন ভবানী। খেপী ওকে দেখে খুব খাতির করলে। কিছুক্ষণ পরে ভবানী বললেন-কেমন চলচে?

 এই আর একটি মেয়ে, খেপী। সন্ন্যাসিনী বেশ, বছর চল্লিশ বয়েস, কোনো কালেই সুন্দরী ছিল না, শক্ত-সমর্থ মেয়েমানুষ। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে একা থাকে। বাঘ আছে, দুষ্ট লোক আছে-কিছু মানে না। ত্রিশূলের এক খোঁচায় শক্ত হাতে দেবে উড়িয়ে-যে-ই দুষ্ট লোক আসুক, এ মনের জোর রাখে।

 খেপী কাছে এসে বললে-আজ একটু সৎকথা শুনবো-

 —ভবানী বাঁড়ুয্যে বললেন হেসে—অসৎ কথা কখনো বলেচি?

২৯০