পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 দ্বারিক কর্মকার বললে—বাঃ বাঃ—

 হাফেজ মণ্ডল বলে উঠলো-আহা-হা, আহা!

 খেপী পেছন থেকে ফুপিয়ে কেঁদেই উঠলো।

 প্রাচীন ভারতবর্ষের হোমধূমাচ্ছন্ন আশ্রমপদ যেন মূর্তিমান হয়ে ওঠে এই পল্লীপ্রান্তে। মহাতপস্বী সে ভারতবর্ষ, সত্যের জন্যে তার যে অটুট কাঠিন্য, ধর্মের জন্যে তার যথাসর্বস্ব বিসর্জন।—সকলেই যেন জিনিসটা স্পষ্ট বুঝতে পারলে। রক্তাপ্লূতদেহ, উর্ধ্ববাহু লিখিত ঋষি চলেচেন 'দাদা’ ‘দাদা' বলে ডাকতে ডাকতে বনের মধ্যে দিয়ে রাজসভা থেকে দাদার অশ্রমে।

 সেদিনই একখানা কাস্তে বাঁধানোর জন্যে একটা খদ্দেরকে এক আনা ঠকিয়েছে-দ্বারিক কর্মকারের মনে পড়ে গেল।

 হাফেজ মণ্ডলের মনে পড়লো গত বুধবারের সন্ধ্যেবেলা সে কুড়নরাম নিকিরির ঝাড় থেকে দু'খানা তলদা বাঁশ না বলে কেটে নিয়েছিল ছিপ করবার জন্যে। সে প্রায়ই এমন নেয়। আর নেওয়া হবে না ওরকম। আহা-হা কি সব লোকই ছিল সেকালে! জামাইঠাকুরের মুখে শুনতে কি ভালোই লাগে!

 খেপী দুটো কলা আর একটা শসার টুকরো ভবানী বাঁড়ুয্যের সামনে নিয়ে এসে রেখে বললে—একটু সেবা করুন। ভবানী খেতে খেতে বলছিলেন—ভগবানের শাসন হোলো মায়ের শাসন। অন্যের ভুল ত্রুটি সহ্য করা চলে, কিন্তু নিজের সন্তানেরও সব আবদার সহ করে না মা। তেমনি ভগবানও। ছেলেকে কেউ নিন্দে করবে, এ তাঁর সহ্য হয় না। ভক্ত আপনার জন তাঁর, তাকে শাসন করেন বেশি। এ শাসন প্রেমের নিদান। তাকে নিখুঁত করে গড়তেই হবে তাঁকে। যে বুঝতে পারে, তার চোখের সামনে ভগবানের রুদ্র রূপের মধ্যে তার স্নেহমাখা প্রেমভরা প্রসন্ন দক্ষিণ মুখখানি সর্বদা উপস্থিত থাকে।

ভবানী বাঁড়ুয্যে ফেরার পথে দেখলেন নিস্তারিণী একা পথ দিয়ে ওদের বাড়ির দিকে ফিরচে। ওঁকে দেখে সে রাস্তার ধারের একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। রাত হয়ে গিয়েছে। এত রাত্রে কোথা থেকে ফিরচে নিস্তারিণী?

২৯৬