পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 —হ্যাঁ বাবা।

 —তোমার সঙ্গেও বলবেন?

 —হ্যাঁ বাবা, আমি চাইলে তিনিও চান। আমি ছাড়া নন তিনি।

 এসব কথা অবিশ্যি ভবানীই শিখিয়েচেন ছেলেকে।

 ছেলেকে বিশেষ কোনো বিত্ত তিনি দিয়ে যেতে পারবেন না। তাঁর বয়েস হয়েচে, এই ছেলেকে নাবালক রেখেই তাঁকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে মহাপ্রস্থানের পথে। কি জিনিস তিনি দিয়ে যাবেন একে—আজকার অবোধ বালক তার উত্তরজীবনের জ্ঞানবুদ্ধির আলোকে একদিন পিতৃদত্ত যে সম্পদকে মহামূল্য বলে ভাবতে শিখবে, চিনতে শিখবে, বুঝতে শিখবে?

 ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস। ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগ।

 এর চেয়ে অন্য কোনো বেশি মূল্যবান সম্পদের কথা তাঁর জানা নেই।

 খুব বেশি বুদ্ধির প্যাঁচের দরকার হয় না, সহজ পথে সহজ হয়েই সেই সহজের কাছে পৌঁছানো যায়। দিনের পর দিন এই ইছামতীর তীরে বসে এই সত্যই তিনি উপলব্ধি করেচেন। সন্ধ্যায় ওই কাশবনে, সাঁইবাবলার ডালপালায় রাঙা ঝোপটি ম্লান হয়ে যেতো, প্রথম তারাটি দেখা দিত তাঁর মাথার ওপরকার আকাশে, ঘুঘু ডাকতো দূরের বাঁশবনে, বনসিমফুলের সুগন্ধ ভেসে আসতো বাতাসে—তখনই এই নদীতটে বসে কতদিন তিনি আনন্দ ও অনুভূতির পথ দিয়ে এসে তাঁর মনের গহন গভীরে প্রবেশ করতে দেখেছিলেন এই সত্যকে—এই চির পুরাতন অথচ চির নবীন সত্যকে। বুঝেচেন এই সত্যটি যে, ভগবানের আসল তত্ত্ব শুধু স্বরূপে সীমাবদ্ধ নয়, স্বরূপ ও লীলাবিলাস দুটো মিলিয়ে ভগবত্তত্ব। কোনটা ছেড়ে কোনোটা পূর্ণ নয়। এই শিশু, এই নদীতীর সেই তত্ত্বেরই অন্তর্ভুক্ত জিনিস। সে থেকে পৃথক নয়—সেই মহা-একের অংশ মাত্র।

 নিস্তারিণী খুব মুগ্ধ হোলো। তার মধ্যে জিনিস আছে। কিন্তু গৃহস্থঘরের বৌ, শুধু রাঁধা-খাওয়া, ঘরসংসার নিয়েই আছে। কোনো একটু ভালো কথা কখনো শোনে না। এমন ধরনের ব্যাপার সে কখনো দেখে নি। তিলুকে বললে—দিদি, আমি আসতে পারি?

৩১২