পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সাধুর কুটিরের বেড়া বাঁধা ছিল শনের পাকাটি দিয়ে। পাহাড়ী ঘাসে ছাওয়া ছিল চাল দুখানা। কি একটা বন্যলতার সুগন্ধী পুষ্প ফুটে থাকতো বেড়ার গায়ে। বনটিয়া ডাকতো তুন্ গাছের সু-উচঃ শাখা-প্রশাখার নিবিড়তারকা ঝর্নার কুলুকুলু শব্দ উঠতো নর্মদার অপর পারের মহাদেও শৈলশ্রেণীর সানুদেশের বনস্থলী থেকে। নিচের কুটিরে বসে ভজন গাইতেন কৈবল্যানন্দজীর শিষ্য অনুপ ব্রহ্মচারী। রাত্রে ঘুম ভেঙে ভবানী শুনতেন করুণ তিলককামোদ রাগিণীর সুর ভেসে আসচে নিচের বুটিক থেকে, গানের ভাঙা ভাঙা পদ কানেআসতো—

“এক ঘড়ি পলছিন কল না পরত মোহে।”

 সকালে উঠে দাওয়ায় বসে দেখতেন আরো অনেক নিচে একটা মস্ত বড় কুসুমগাছ, তার পাশে একটা তেঁতুল গাছ। বড় বড় পাথরের বাটলে বাংলাদেশের দশবাইচণ্ডী জাতীয় এক রকম বনফুল অসংখ্য ফুটতে। এগুলোর কোন গন্ধ ছিল না, সুগন্ধে বাতাস মদির করে তুলতো সেই বন্যলতার হলুদ রংয়ের পুষ্পস্তবক। কেমন অপূর্ব শান্তি, কি সুস্নিগ্ধ ছায়া, পাখীর কি কলকাকলী ছিল বনে, নদীতীরে। কেউ আসত না নিস্তবদ্ধতা ভঙ্গ করতে, অবিচ্ছিন্ন নির্জনতার মধ্যে ভগবানের ধ্যান জমতো কি চমৎকার। নেমে এসে নর্মদায় স্নান ক’রে আবার পাহাড়ে উঠে যেতেন পাথরে পা দিয়ে দিয়ে।

 সেই সব শান্তিপূর্ণ দিনের ছবি মনে পড়ে কবিরাজ মশাইয়ের ঘরটাতে এসে বসলে। কিন্তু ফণি চক্কত্তির চণ্ডীমণ্ডপে গেলে শুধু বিষয়-আশয়ের কথা, শুধুই পরচর্চা। ফণি চক্কত্তি একা নয়, যার কাছে যাবে, সেখানেই অতি সামান্য গ্রাম্যকথা। ভালো লাগে না ভবানীর।

 আর একটা কথা মনে হয় ভবানীর। ঠাকুরের মন্দির হওয়া উচিত এই রকম ছোট পর্ণকুটিরে, শান্ত বন্য নির্জনতার মধ্যে। বড় বড় মন্দির, পাথর-বাঁধানো চত্বর, মার্বেল বাঁধানো গৃহতলে শুধু ঐশ্বর্য আছে, ভগবান নেই। অনেক ঐ রকম মন্দিরের সাধুদের মধ্যে লোভ ও বৈষয়িকতা দেখেছেন তিনি। শ্বেত পাথর বাঁধানো গৃহতল সেখানে দেবতাশূন্য।

 রামকানাই জিগ্যেস করলেন—বাঁড়ুয্যেমশাই, বৃন্দাবন গিয়েচেন?

৩২৬