পাতা:ইছামতী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 —যাই নি।

 —এত জায়গায় গেলেন, ওখানডাতে গেলেন না কেন?

 —বৃন্দাবন লীলা আমার ভালো লাগে না।

 —আমার আর কি বুদ্ধি, কি বোঝাবো! সংসারের নানা ঝন্‌ঝাটে ভক্ত আশ মিটিয়ে ভগবানের প্রেমকে উপভোগ করতে পারে না, তাই একটা চিন্ময় ধামের কথা বলা হয়েচে, সেখানে শুধু ভক্ত আর ভগবানের প্রেমের লীলা চলচে। এতাই বৃন্দাবন লীলা।

 —খুব ভালো কথা। যে বৃন্দাবনের কথা বললেন, সেটা বাইরে সর্বত্রই রয়েচে। চোখ থাকলে দেখা যাবে ওই ফুলে, পাখীর ডাকে, ছেলেমানুষের হাসিতে তিনিই রয়েচেন।

 —ওই চোখডা কি সকলে পায়?

 —সেজন্যে হাতড়ে বেড়ায় এখানে ওখানে। প্রাচীন শাস্ত্র বেদ, যে বেদ প্রকৃতির গায়ে লেখা আছে। আমার মনে হয় ফুল, নদী, আকাশ, তারা, শিশু এরা বড় ধর্মগ্রন্থ। এদের মধ্যে দিয়ে তাঁর লীলাবিভূতি দর্শন হয় বেশি ক’রে। পাথরে গড়া মন্দিরে কি হবে, যার ভেতর তিনি নিজে থাকেন সেটাই তাঁর মন্দির। ওই চড়পাড়ার বিলে আসবার সময় দেখলাম কুমুদ ফুল ফুটে আছে, ওটাই তাঁর মন্দির। বাইরের প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতির তালে তালে চলে তাকে ভালোবেসে সেই প্রকৃতির সাহায্যে প্রকৃতির অন্তরাত্মা সেই মহান শক্তির কাছে পৌঁছতে হবে।

 একেই বলেচে বৈষ্ণব শাস্ত্রে ‘যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে, তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে’।

 —ঠিক কথা, শুধু একটা মন্দিরে বা তীর্থস্থানে তিনি আছেন? পাগল নাকি! ‘বনস্পতৌ ভূভৃতি নির্ঝরে বা কুলে সমুদ্রস্য সরিৎতটে বা’ সব জায়গায় তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে রয়েচেন, অথচ চোখ খুলে না যদি আমি দেখি, তবে তিনি নাচার। তিনি শিশুবেশে এসে আমার গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন, আমি ‘মায়ার বন্ধন’ বলে আঁৎকে উঠে ছুটে পালালুম, এ বুদ্ধি নিয়ে এ চোখ দিয়ে কি ভগবান দর্শন হয়? তাঁর হাতের বন্ধনই তো মুক্তি। মুক্তি-মুক্তি

৩২৭