পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০১০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

ভিতরে গুটিসুটি হয়ে বসে, হাঁ করে পথের শোভা দেখতে দেখতে দার্জিলিং যেতে হয়।

 দার্জিলিঙের পথে বনের শোভা বড় চমৎকার। একলা সে বনের ভিতর যেতে হলে প্রাণটি হাতে করে যেতে হয়, কিন্তু ট্রেনে যেতে কোনো ভয় নেই। একবার কিন্তু ট্রেনের সামনে একটা মস্ত বুনো হাতি পড়েছিল। সে হয়তো ট্রেনটাকে নতুনরকমের কোনো জানোয়ার মনে করে থাকবে, তাই বোধহয় লাইনের উপর দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল যে সেটার সঙ্গে লড়বে কি ভাগবে। এমন সময় ড্রাইভার পোঁ করে বাঁশি বাজিয়ে ট্রেনখানাকে খুব জোরে চালিয়ে দিল আর হাতিও তা দেখে মাগো! বলে লেজ গুটিয়ে দে প্রাণপনে ছুট!

 ট্রেনখানি সেই বনের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কেয়োর মতো এঁকেবেঁকে চলে। ত্রিশ ফুট পথ এগুলে তার এক ফুট উঁচুতে ওঠা হয়। পথের ধারে বিশাল বড়বড় সব গাছ, তাতে নানা রঙের ফুলও আছে কোনো কোনোটাকে প্রকাণ্ড লতার জালে জড়িয়ে রেখেছে, কোনো কোনোটার গায়ে লম্বা-লম্বা দড়ির মতো শ্যাওলা ঝুলছে। নীচের দিকে তাকাই-উঃ! কি ঘন বন। পাহাড়ের গা ঢেকে দিনকে রাত করে রেখেছে। যদি গাড়ি থেকে পড়ে যাই, তাহলে অমনি বনের ভিতর দিয়ে গড়িয়ে কোথায় চলে যাব। উপরের দিকে তাকাই বাবা! কি উঁচু সব গাছ! জাহাজের মাস্তুলের মতো সোজাসুজি সেই কোথায় উঠে গিয়াছে। ত্রিশ-চল্লিশ হাত অবধি তাদের অনেকের গা একেবারে খালি, শুধু মাথায় খানিকটা ডালপালা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় না যে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনোরকম পরিচয় আছে। কিন্তু একটু ভালো করে দেখলে মাঝে মাঝে এক একটা শিমুল, কদম বা আর কোনো জানা গাছ ধরা পড়ে, তাদেরও সেইরকম হাড়গিলেপানা চেহারা।

 গাছের আলো না হলে চলে না। সেই আলোর জন্য ব্যস্ত হয়ে তারা রেষারেষি করে কেবলই উঁচু হতে থাকে। কেননা, ঘন বনের ভিতরে পাশ দিয়ে আলো খুব কমই আসতে পারে, পাশাপাশি বাড়বার জায়গাও নাই। এসব বনে যে বাশ যথেষ্ট আছে, সে কথা আগেই শুনেছ। এসব বাঁশের একেকটা এমনি মোটা যে খুব রোগা একজন লোকের কোমরের সঙ্গে তার একটাকে মেপে বাঁশটাই মোটা দাঁড়িয়েছিল।

 এর এক একটা চোঙ্গায় এক কলসী জল অনায়াসে ধরে। পাহাড়ী ললাকেরা এই চোঙ্গা দিয়েই কলসীর কাজ চালায়। কলসীর চেয়ে এগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলতে ফিরতে অনেক সুবিধা, তাতে আবার এগুলো সহজে ভাঙ্গে না। বনের ভিতরে বড়-বড় অনেক কলাগাছও দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু সে কলা বানরেও খেতে পারে কিনা সন্দেহ, তাতে এতই বীচি।

 এমনি বনের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে ঝাঁ করে ট্রেনখানা এক একটা ফাঁকা জায়গায় আসে;তখন দেখা যায় ইস, কত উঁচুতে উঠে এসেছি বাঙ্গালার মাঠ ঐ ধূধূ করছে। বড়- বড় নদীগুলি সাদা আঁচড়ের মতো সেই কোথায় চলে গিয়েছে।

 দেড় হাজার ফুট উঁচুতে উঠলে মেঘের সঙ্গে দেখা হয়। দেশে বসে আকাশের পানে তাকিয়ে আমরা যেসব ভারী ভারী মেঘ দেখতে পাই, তারা মোটামুটি এইরকম উঁচুতেই থাকে। ক্রমে হয়তো ট্রেন তার ভিতরে ঢুকে যায়। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে আমরা যাকে কুয়াশা বলি, এ ঠিক সেই জিনিস। দূরে থেকে তাকে দেখলেই সে মেঘ, আর ভিতরে ঢুকে দেখলেই সে কুয়াশা।

 ততক্ষণে বনের শোভা একটু কমে এসেছে, আর মেঘের আর মাঠের শোভা বাড়ছে।