পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ প্রবন্ধ
১০১১

মাঝে মাঝে একেকটা সুন্দর ঝরনাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আগে পাগলাঝোরা বলে একটা খুব বড় ঝরনা ছিল, তার পাগলামি একটু বেশি হলেই সে রেলের পথটা ভেঙ্গে ঠিক করে দিত। এখন পাহাড়ের গায়ে নানান দিকে পথ করে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কাজেই আর তার তেমন রাগ রঙ্গ নাই। তিন হাজার ফুটের উপরে উঠলে এই ঝোরাটাকে দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে যেসব মেঘের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এরপর থেকে তারা ক্রমেই নীচে পড়ে যেতে থাকে। তারপর ক্রমে মাঠের যে কী শোভা হতে থাকে, সে না দেখলে বুঝবার সাধ্য নাই। তখন আমাদের দেশের ভারী ভারী মেঘগুলোকে দেখে মনে হয় যেন তারা দল বেঁধে ঘাস খাবার জন্য মাঠে গিয়ে নেমেছে।

 এক মাইল উঁচুতে উঠলে প্রায় নববুই মাইল দূর অবধি মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এত দূর থেকে বিশেষ কিছুই বুঝতে পারা যায় না, কিন্তু মনের ভিতরে কি যে একটা আনন্দ হয় সে কি বলব!

 এতক্ষণে আর একটা খুব আনন্দের ব্যাপার ঘটে যায়। প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট অবধি ট্রেনখানা বড় বড় পাহাড়ের দক্ষিণদিক বেয়ে চলতে পাকে; সেসব পাহাড়ের উত্তরে যে কি আছে তা দেখা যায় না। তারপর যেই হঠাৎ একবার মোড় ফিরে, সেই পাহাড়গুলোকে ডান হাত ফেলে সে উত্তরমুখো হয়, অমনি দেখা যায়, হিমালয়ের সাদা সাদা বরফে ঢাকা চুড়োগুলো রোদে ঝিকমিক করছে।

 তারপরে শীতটিও ক্রমে জেঁকে উঠতে থাকে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে এবারে এক নতুন রাজ্যে আসা গেছে, তার নতুন রকমের হাওয়া, নতুনরকমের শোভা, সেখানে নতুন ধরনের মানুষ, নতুনতর মেঘের খেলা।

 দার্জিলিঙের পথে সবচেয়ে উঁচু ষ্টেশন হচ্ছে ঘুম। দার্জিলিং তারই এক ষ্টেশন পরে, আর খানিকটা নীচে। এই পথটুকু টেনখানি আপনি গড়িয়ে যায় ইঞ্জিনের আর তাকে টানতে হয় না। নেমে আসবার সময় দার্জিলিং থেকে ঘুম অবধি ট্রেনখানাকে ইঞ্জিনে টেনে পৌঁছে দেয়;তারপর ঘুম থেকে সুকনা অবধি ট্রেন অমনি চলে আসে। ইঞ্জিনখানা তাকে সামলে রাখবার জন্য সঙ্গে থাকে বটে, কিন্তু তাকে টানতে তো হয়ই না, ব্রেক কষে একটু পিছভাগে ঠেলে রাখতে হয়।

 ঘুম থেকে দার্জিলিং মোটে পাঁচ মাইল, এইটুকু যেতে আর বেশি সময় লাগে না। চলতে চলতে হঠাৎ একবার মোড় ফিরেই দার্জিলিং শহরটি দেখতে পাওয়া যায়। ময়রার দোকানে যেমন করে মিঠাইয়ের থালাগুলি সাজিয়ে রাখে, পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলি অনেকটা সেইভাবে সাজানো। দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। কিন্তু দার্জিলিঙের আসল শোভা ঘরবাড়িতে নয়, সে হচ্ছে মেঘের আর হিমালয়ের আর আলো আর ছায়ার শোভা।

 দেশে থেকে ঘরে বসে আমরা এই মেঘকেই দেখতে পাই:এই মেঘই সমুদ্রের কোলে জন্মলাভ করে, বাঙ্গালার মাঠের উপর দিয়ে এতখানি হাওয়া বেয়ে এসে দার্জিলিঙে উপস্থিত হয়েছে। দেশে বসে তো শিশুকাল থেকে একে দেখে দেখে বুড়ো হয়ে গেছি, তবে আবার এখানে এসে এর এত নতুন শোভা হল কোখেকে?

 শোভা হয়েছে এইজন্য যে আমাদের দেশে থাকতে দূর হতে উপরভাগে চেয়ে, তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম, আর এখন তার নিজের দেশে এসে, তার পেটের