পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

রহিলেন, আর দাঁড়াইবার শক্তি নাই। রথ চোখের আড়ালে চলিয়া গেল, আর বসিয়াও থাকিতে পারিলেন না।

 একটু সুস্থ হইলে পরে দশরথ কৌশল্যার হাতখানি ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে চলিলেন—কৈকেয়ীর ঘরে নহে, কৌশল্যার ঘরে। কৈকেয়ী রাজাকে নিতে আসিলেন, কিন্তু রাজা বলিলেন, ‘তুই আমাকে ছুঁইস না।’

 কৌশল্যার ঘরে আসিয়া দশরথ সেই যে বিছানায় শুইলেন, তাহাই তাঁহার শেষ শয়ন। কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। রাত্রিতে অনেক কষ্টে কৌশল্যাকে বলিলেন, “আমি তোমাকে দেখিতে পাইতেছি না। আমার গায়ে হাত দাও! ‘ কৌশল্যা রাজার কাছে আসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহার দুঃখ দেখিয়া সুমিত্রা বলিলেন, দিদি, এত দুঃখ কেন করিতেছ? রাম কেমন বীর তাহা কি জান না? লক্ষ্মণও তাহার সঙ্গে গিয়াছে, তাহদের কিসের ভয়? আবার তাহারা অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিবে!’ সুমিত্রার কথা শুনিয়া কৌশল্যা অনেক শাস্ত হইলেন।

 দশরথকে যখন ফিরাইয়া আনা হইল, তখনও অযোধ্যার অনেক লোক রথের সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছিল। তাহারা কিছুতেই ফিরিতে চাহিল না। তাহাদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁহাদের গায়ে জোর নাই, মাথা কাঁপে, তবুও তাঁহারা যাইবেনই। তাঁহাদের কষ্ট দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ আর সীতা রথ হইতে নামিয়া তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া চলিলেন। ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, বাছ রাম, আমরা সঙ্গে যাইব।’

 এইরূপে তাঁহারা তমসা নদীর ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ততক্ষণে সন্ধ্যা হইয়াছে। কাজেই সেখানেই রাত্রিতে থাকিবার আয়োজন হইল।

 ভোরে উঠিয়া রাম দেখিলেন যে, অযোধ্যার লোকেরা তখনও ঘুমাইতেছে। তখন তিনি চুপি চুপি সুমন্ত্রকে উঠাইয়া বলিলেন, ‘চল, এইবেলা আমরা চলিয়া যাই। সুমন্ত্র রথ সাজাইয়া আনিলেন, কিন্তু রাম লক্ষ্মণ ও সীতা তাহাতে চড়িয়া আর বেশি দূরে গেলেন না। খানিক পরেই তাঁহারা রথ হইতে নামিয়া সুমন্ত্রকে বললেন, তুমি রথখানিকে উত্তর দিক হইতে ঘুরাইয়া আন। শুধু রথ হালকা বলিয়া পথে কিনা তাহার দাগ পড়িবে না, তাই রাম শুধু রথখানিকে ঘুরাইয়া আনিতে দিলেন। তিনি জানিতেন যে ঐ রূপ করিলে আর অযোধ্যার লোকেরা রথের চিহ্ন দেখিয়া তাঁহাদিগকে খুজিয়া বাহির করিতে পরিবে না। তাই তাঁহারা পথ ছাড়িয়া বনের ভিতর দিয়া চলিতে লাগিলেন, আর সুমন্ত্র শুধু রথখানিকে কিছু দূরে ঘুরাইয়া আনিয়া, অন্য এক স্থান হইতে আবার তাঁহাদের তিনজনকে তুলিয়া লইলেন।

 এদিকে তমসা নদীর ধারে সেই লোকগুলি জাগিয়া দেখিল যে রাম নাই। তখন তাহার এই বলিয়া কাঁদিয়া অস্থির হইল, ‘হায় হায়, কেন ঘুমাইলাম? আমাদের ভাগ্যে কি এই ছিল? রাম কি শেষে এইরূপ করিয়া আমাদিগকে ফেলিয়া গেলেন?’ কাঁদিতে কাঁদিতে তাহারা রথের চিহ্ন দেখিয়া খানিক দূরে গেল। কিন্তু তাহার পরে রথ কোনদিকে গিয়াছে আর কিছু বুঝিতে পারিল না। কাজেই তখন নিতান্ত দুঃখের সহিত তাহাদিগকে অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিতে হইল। সমস্তদিন রথ চালাইয়া, রাম বিকালে শৃঙ্গবের নগরের নিকট গঙ্গার ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে একটি সুন্দর ইঙ্গুদী গাছ দেখিয় তিনি বলিলেন, ‘এই গাছতলায় আজ আমরা থাকিব।’