পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৪
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

বাঁধিয়া পার হইবার জন্য ভেলা প্রস্তুত হইল। ভেলার উপর আবার জামের আর বেতের ডাল দিয়া একটা গদি করিতেও বাকি রহিল না—সীতার বসিবার জন্য একটু মোলায়েম জায়গা তো চাই! এই কারিকুরিটি অবশ্য লক্ষ্মণের; সীতার সুবিধা করিতে তিনি সর্বদা ব্যস্ত। এই ভেলায় জিনিসপত্র- সুদ্ধ তাঁহারা নদী পার হইলেন।

 তারপর আগে লক্ষ্মণ, মাঝখানে সীতা, পিছনে রাম—এরূপ করিয়া তাহারা পথ চলিতে লাগিলেন। পথের দুই ধারে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটিয়া আছে সীতা তাহা পূর্বে কখনও দেখেন নাই। তিনি তাহার মিষ্টি কথায় রামকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটি কী ফুল? অমনি লক্ষ্মণ তাহা তুলিয়া আনিয়া দেন।

 এইরূপে এক দিন পথ চলিয়া তাহারা চিত্রকূট পর্বতের কাছে আসিলেন। সে স্থানটি অতি চমৎকার। তাহার কাছে মন্দাকিনী নামে অতিসুন্দর একটি নদী। সেই নদীর ধারে তাহারা কাঠ আর লতাপাতা দিয়া সুন্দর একখানা ঘর বাঁধিলেন। মণিমাণিক্যের কাজ করা মার্বেল পাথরের বাড়িতে থাকা যাঁহাদের অভ্যাস,এখন তাহদের থাকিবার জায়গা হইল একটি কুঁড়ে। সেই কুঁড়ে ঘরখানিতে তাহাদের বেশ সুখেই দিন কাটিতে লাগিল।

 সুমন্ত্র অযোধ্যায় ফিরিয়া আসিলে তাঁহাকে দেখিয়া দশরথের দুঃখ আরও বাড়িয়া গেল। প্রথমে তিনি অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিলেন। জ্ঞান হইলে পর জিজ্ঞাসা করিলেন, সুমন্ত্র, তুমি চলিয়া আসার সময় তাহারা কী বলিল? সুমন্ত্র বলিলেন, রাম আপনাদের সকলকে প্রণাম জানাইয়াছেন; আর বলিয়াছেন, “মাকে বলিও তিনি যেন সর্বদা বাবার সেবা কবেন। ভরতকে বলিও, তিনি যেন রাজা হইয়া বাবাকে অমান্য না করেন।” লক্ষ্মণ রাগেব সহিত বলিলেন, “সুমন্ত্র, বাবা যখন দাদাকে বনে পাঠাইয়াছেন, তখন আর তাহার উপরে আমার একটুও ভক্তি নাই।” সীতা কিছুই বলেন নাই, তিনি কেবল হেঁটমুখে চোখের জল ফেলিয়াছেন, আর এক-এক বার রামের মুখের দিকে আর রথের দিকে তাকাইয়াছেন।

 ইহার পর রাজা দশরথ ক্রমেই অস্থির হইয়া পডিতে লাগিলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে তিনি আর অধিকক্ষণ বঁচিবেন না। যখন তাহার বয়স অল্প ছিল, তখন তিনি একবার অন্ধকার রাত্রিতে হাতি মনে করিয়া একটি অন্ধ মুনির ছেলেকে তীর দিয়া মারিযা ফেলেন। তাহাতে সেই অন্ধ মুনি দুঃখে মরিয়া যান, আর মরিবার পূর্বে দশরথকে এই বলিয়া শাপ দেন, “তোমার এইরূপে পুত্রের শোকে প্রাণ যাইবে।”

 মৃত্যুর সময় সেই কথা মনে করিযা দশরথ দুঃখ করিতে লাগিলেন। তারপর ক্রমে তাহার শরীর অবশ হইয়া আসিল। শেষে হা রাম! হা কৌশল্যা! হা সুমিত্রা! হা রে দুষ্ট কৈকেয়ী!” এই বলিতে বলিতে রাত্রি দুই প্রহরের সময় তার প্রাণ বাহির হইয়া গেল। রামকে বনে পাঠাইয়া ছয়দিন মাত্র দশরথ বাঁচিয়া ছিলেন।

 রামের জন্য ক্রমাগত কয়েক দিন দুঃখ করিয়া করিয়া সকলে একেবারে অবশ হইয়া পড়িয়াছিলেন;দশরথের মৃত্যুর সময় কেহই টের পান নাই। পরদিন দশরথকে জাগাইতে গিয়া সকলে দেখিলেন যে তিনি মরিয়া গিয়াছেন। তখন আবার কান্না আরম্ভ হইল।

 এইরূপে দুঃখের উপর আবার দুঃখ আসিয়া সকলকে যে কিরূপ অস্থির করিয়াছিল, তাহা কী বলিব! এদিকে ভরত শত্রুঘ্নও বাড়ি নাই, তাহারা না আসিলে দশরথকে পোড়ানোও যাইতেছেনা। সুতরাং তাড়াতাড়ি ভরত শত্রুঘ্নকে আনিতে লোক গেল। আর যতদিন তাঁহারা