পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

পান, এবং উহা কিসের কলরব তাহা জানিবার জন্য লক্ষ্মণ একটা শাল গাছে গিয়া উঠেন। সেখান হইতে চারিদিক দেখিয়া তিনি রামকে বলিলেন, ‘দাদা শীঘ্র আগুন নিভাইয়া ফেল, আর বর্ম পরিয়া তীর ধনুক লইয়া প্রস্তুত হও! ভরত আমাদিগকে মারিয়া ফেলিতে আসিয়াছে!

 এ কথায় রাম বলিলেন, ‘ভাই, ভরত কি কখনও তোমার অনিষ্ট করিয়াছে? তবে কেন তাহাকে সন্দেহ করিতেছ?”

 ইহাতে লক্ষ্মণ লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “বোধহয় বাবা তোমাকে দেখিতে আসিয়াছেন। রাম বলিলেন, তাহা হইতে পারে। আমরা বনে থাকিয়া কষ্ট পাইতেছি, তাই বোধহয় বাবা আমাদিগকে লইয়া যাইতে আসিয়াছেন। কিন্তু বাবার সঙ্গে তো সকল সময়েই প্রকাণ্ড শাদা ছাতা থাকে। সে ছাতা কই? তুমি শীঘ্র গাছ হইতে নামিয়া আইস।’

 এদিকে ভরত খুজিতে খুজিতে ক্রমে রামের ঘরের কাছে আসিয়া উপস্থিত। লতাপাতার ঘরখানি, তাহার ভিতরে রামের ধনুক দেখা যাইতেছে। আরও কাছে আসিলে দেখিলেন, রাম ঘরের ভিতর চামড়ার আসনে বসিয়া সীতা ও লক্ষ্মণের সহিত কথাবার্তা বলিতেছেন; পরনে গাছের ছাল, মাথায় জটা। তাহা দেখিয়া ভরতের মনে কী কষ্টই হইল! তিনি ছুটিয়া চলিলেন, কিন্তু পৌছিবার আগেই পড়িয়া গেলেন। মুখ দিয়া কেবল ‘দাদা’ এই কথাটি মাত্র বাহির হইয়াছিল, আর কথা সরিল না। ততক্ষণে শত্রুঘ্নও কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়া রামের পায়ে পড়িলেন। তারপর চারি ভাই গলা জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

 তাঁহারা একটু শাস্ত হইলে পর রাম বলিলেন, ভরত, বাবা এখন কোথায়? তুমি তাঁহাকে ছাড়িয়া কেন আসিলে?’ ভরত বলিলেন, ‘দাদা, বাবা তোমার জন্য দুঃখ করিতে করিতে স্বর্গে চলিয়া গিয়াছেন। এখন আমরা তোমাকে লইতে আসিয়াছি। তোমার পায়ে পড়ি দাদা, আমাদের সঙ্গে চল!” এই বলিয়া ভরত রামের পা জড়াইয়া ধরিলেন।

 দশরথের মৃত্যুর সংবাদে রাম কাঁদিতে কাঁদিতে ভরতকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, ভাই, বাবা যাহা বলিয়া গিয়াছেন, তাহা আমারও করা উচিত, তোমারও করা উচিত। আমাকে যখন বনে পাঠাইয়াছেন, তখন আমি অযোধ্যায় কী করিয়া যাইব? আর তোমাকে যখন তিনি রাজা হইতে বলিয়া গিয়াছেন, তখন তুমিই বা কী করিয়া সে কথা অমান্য করিবে?'

 তারপর দশরথের তপণ করিবার জন্য রাম মন্দাকিনী নদীর ধারে আসিলেন। তপণ শেষ হইলে আবার কান্না আরম্ভ হইল। সেই কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া ভরতের সঙ্গের লোকেরা আর দূরে বসিয়া থাকিতে পারিল না।

 ততক্ষণে বেলা প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছিল যাহা কিছু বেলা ছিল, তাহাও সকলের দেখাশুনা, প্রণাম, আশীর্বাদ ইত্যাদিতে কাটিয়া গেল। তারপর রাত্রি কেমন করিয়া কাটিল, তাহার কথা আর বেশী বলিয়া কী ফল? এত দুঃখ যাহদের, তাহারা সে রাত্রি কেমন দুঃখে কাটাইয়াছিল, তাহা তোমরা নিশ্চয় বুঝিতে পারিতেছ।

 পরদিন রামকে অযোধ্যায় লইয়া যাইবার জন্য অনেক চেষ্টা হইল। কিন্তু রাম কিছুতেই যাইতে চাহিলেন না। কেবল চেষ্টা করিলে কী হইবে? তাহাকে তো এ কথা বুঝাইয়া দেওয়া চাই যে, বনে যাওয়া উচিত নহে, অযোধ্যায় ফিরিয়া যাওয়াই ভাল:নহিলে তিনি যাইবেন কেন? ভরত অনেক মিনতি করিয়াছিলেন বটে, বশিষ্ঠও নানারূপ মিষ্ট উপদেশ দিয়াছিলেন।