পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১১১

 পুঁতিয়া ফেলি।’ এ কথা বলিয়া রাম সেই রাক্ষসের গলাটা পায়ে চাপিয়া ধরিলেন।

 তখন রাক্ষস বলিতে লাগিল, বুঝিয়াছি, আপনারা রাম লক্ষ্মণ। আমি তম্বরু নামে গন্ধর্ব ছিলাম, কুবেরের শাপে রাক্ষস হইয়াছি। কুবের আমাকে শাপ দিবার সময় বলিয়াছিলেন যে, দশরথের পুত্র রাম যুদ্ধ করিয়া আমাকে মারিলে, আমি আবার গন্ধর্ব হইয়া স্বর্গে যাইব।’ এইরূপে নিজের পরিচয় দিয়া রাক্ষস বলিল, এখান হইতে দেড় যোজন দূরে শরভঙ্গ মুনি থাকেন। সেখানে গেলে আপনাদের ভাল হইবে। এরপর একটা গর্ত খুঁড়িয়া বিরাধকে পুঁতিলেই হয়। গর্ত খুঁড়িতে লক্ষ্মণের অধিক কষ্ট হইল না, কিন্তু পুঁতিবার সময় বিরাধ বড়ই চ্যাঁচাইয়াছিল।

 তারপর তিনজনে শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে গেলেন। রামকে দেখিতে শরভঙ্গের বড়ই ইচ্ছা। ইন্দ্র তাঁহাকে ব্রহ্মলোকে লইয়া যাইতে আসেন, কিন্তু রামকে না দেখিয়া তিনি সেখানে যাইতে চাহেন নাই। রাম যে আসিবেন তাহা তিনি আগেই জানিতেন, আর শুধু তাঁহাকে দেখিবার জন্যই অপেক্ষা করিতেছিলেন।

 রামকে দেখা যখন হইয়া গেল, তখন আর এই পৃথিবীতে তাঁহার প্রয়োজন রহিল না। সুতরাং তিনি তখন রামের সম্মুখে নিজ হাতে আগুন জ্বালিয়া, তাহার ভিতরে গিয়া বসিলেন। তারপর দেখিতে তাঁহার সেই পুরাতন রোগ পাকা-চুল-দাড়িওয়ালা শরীর পুড়িয়া গিয়া, তাহার বদলে অতি সুন্দর আর উজ্জল একটি বালকের মত চেহারা হইল। তখন তিনি রাম লক্ষ্মণকে বলিলন, ‘এখান হইতে তোমরা সুতীক্ষ্ন মুনির আশ্রমে যাইও, তাহাতে তোমাদের উপকার হইবে।” এই বলিয়া তিনি ব্রহ্মলোকে চলিয়া গেলেন।

 শরভঙ্গ মুনি স্বর্গে চলিয়া গেলে পর অন্য অনেক মুনি রামকে দেখিতে আসিলেন। তাঁহাদের নিকট রাম জানিতে পারিলেন যে, রাক্ষসেরা তাঁহাদের উপর বড়ই অত্যাচার করে। তাহা শুনিয়া রাম বলিলেন, ‘আপনাদের ভয় নাই, আমি রাক্ষস দূর করিয়া দিব।’

 তারপর রাম লক্ষ্মণ আর সীতা সুতীক্ষ্নের আশ্রমে গেলেন। সুতীক্ষ্নের ইচ্ছা ছিল যে, রাম আর অন্য কোথাও না গিয়া তাহার আশ্রমেই থাকেন। কিন্তু দণ্ডক বনের অন্যান্য মুনিদের সহিত দেখা করিতে রামের নিতান্ত ইচ্ছা দেখিয়া তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা তবে যাও, কিন্তু দেখা হইয়া গেলে আবার আমার এখানে আসিবে।’ রাম লক্ষ্মণ তাহাতে সম্মত হইয়া, তাঁহাকে প্রণাম করিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।

 ইহার পর দশ বৎসর ধরিয়া রাম লক্ষ্মণ দণ্ডকারণ্যের তপোবন সকল দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহারা যে মুনির নিকটেই যান তিনিই তাঁহাদিগকে কিছুদিন না রাখিয়া ছাড়েন না। কোথাও মাসেক, কোথাও চার পাঁচ মাস, কোথাও এক বৎসর, এইরূপে দশ বৎসর মুনিদের আশ্রমে আশ্রমে কাটাইয়া, শেষে তাঁহারা আবার সুতীক্ষ্নের নিকটে আসিয়া কিছুদিন রহিলেন।

 সকল মুনির সহিতই দেখা হইল, কিন্তু অগস্ত্য মুনির সহিত দেখা এখনও হয় নাই। রাম ভাবিলেন যে, এখন একবার তাঁহার সহিত দেখা করিলে বড় ভাল হয়। তাই তাঁহারা সুতীক্ষ্নের নিকট বিদায় লইয়া অগস্ত্যের আশ্রমে গেলেন।

 মুনিদের মধ্যে অগস্ত্য একজন অতিশয় বড় লোক। তাঁহার এক একটা কাজ বড়ই আশ্চর্য। একবার তিনি চুমুক দিয়া সমুদ্রটাকে খাইয়া ফেলেন। ইল্বল আর বাতাপি নামক দুইটা দৈত্যকে তিনি যেমন করিয়া মারেন, তাহা অতি চমৎকার।

 ইল্বল আর বাতপি দুই ভাইছিল। ইহাদের কাজ ছিল কেবল ব্রাহ্মণ মারিয়া খাওয়া। ইল্বল ব্রাহ্মণ সাজিয়া, সংস্কৃত কথা আওড়াইতে আওড়াইতে ব্রাহ্মণদিগকে নিমন্ত্রণ করিতে যাইত।