পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১১৭

বার বার ফিরিয়া তাকাইতে লাগিলেন, পাছে সীতার কোন অনিষ্ট হয়।

 লক্ষ্মণ চলিয়া যাওয়া-মাত্রই সন্ন্যাসীর বেশে রাবণ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। হাতে ছাতা লাঠি আর কমণ্ডলু, মাথায় টিকি, পায়ে জুতা, কপালে লম্বা ফোঁটা, মুখে ঘন-ঘন হরিনাম। দুষ্ট ক্রমে ঘরের দরজায় আসিয়া সীতার সহিত কথাবার্তা জুড়িয়া দিল; সীতা মনে করিলেন, বুঝি সে যথার্থই ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী। কাজেই তিনি তাহাকে নমস্কার করিয়া, বসিবার জন্য কুশাসন আর পা ধুইবার জন্য জল আনিয়া দিলেন। তারপর তিনি হাত জোড় করিয়া বলিলেন, ‘ঠাকুর, ফলমূল আনিয়া দিই দয়া করিয়া কিছু আহার করুন।’

 রাবণ এইরূপ সীতার সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া শেষে বলিল, ‘আমি লঙ্কার রাজা রাবণ। তুমি বনে থাকিয়া, এই তপস্বীটার সঙ্গে মিছামিছি এত কষ্ট কেন করিতেছ? আমার সঙ্গে লঙ্কায় চল। সেখানে তুমি যার-পর নাই সুখে থাকিবে।’

 এই কথা শুনিয়া সীতা ভয়ানক রাগের সহিত বলিলেন, ‘বটে রে দুষ্ট, তোর এত বড় কথা! এর উচিত সাজা তুই এখনি পাইবি!’

 তখন রাবণ সন্ন্যাসীর সাজ ফেলিয়া তাহার নিজের চেহারায় দাঁড়াইল। সে যে কী বিকট মূর্তি, তাহা কী বলিব! দশটা মাথা, কুড়িটা হাত, কুড়িটা চোখ—দেখিলেই ভয়ে প্রাণ উড়িয়া যায়! এইরূপ চেহারা করিয়া সে সীতাকে বলিল ‘তুমি বুঝি পাগল, তাই আমাকে চিনিতে পারিতেছ না? রামের মায়া ছাড়িয়া দাও। সেটা হতভাগা, তাহাকে ভালবাসা কি তোমার উচিত?’

 এই কথা বলিতে বলিতেই রাবণের রথ সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাবণও সীতার চুল ধরিয়া তাঁহাকে সেই রথে নিয়া তুলিতে আর বিলম্ব করিল না। সীতা রামের নাম ধরিয়া চিৎকার করিয়া কতই কাঁদিলেন, তাঁহার শরীরে যেটুকু জোর ছিল, তাহা লইয়াই প্রাণপণে ছুটিয়া পালাইবার জন্য কতই চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সেই ভয়ানক রাক্ষসের সঙ্গে তিনি পারিবেন কেন? রথ তাঁহাকে লইয়া আকাশে উড়িয়া চলিল। সীতা পশুপক্ষীকে, বনদেবতাদিগকে, গোদাবরী নদীকে ডাকিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘ওগো, তোমরা দয়া করিয়া রামকে সংবাদ দাও। তাঁহার সীতাকে দুষ্ট রাবণ চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছে!’

 সে সময়ে বুড়া জটায়ু পক্ষী গাছে বসিয়া ঘুমাইতেছিল। সীতার কান্নার শব্দে সে জাগিয়া দেখিল যে, রাবণ তাহাকে লইয়া পালাইতেছে! তাহা দেখিয়া জটায়ু বলিল, ‘বটে রে দুষ্ট রাক্ষস, আমি এখানে থাকিতেই তুই সীতাকে লইয়া পলাইবি? এখনই নখ দিয়া তোর মাথা ছিঁড়িয়া দিতেছি!’

 তখন জটায়ু আর রাবণে বিষম যুদ্ধ বাধিয়া গেল। রাবণ জটায়ুকে ভয়ানক ভয়ানক বাণ মারে, আর জটায়ু নখের আঁচড়ে তাহার মাংস ছিঁড়িয়া নিতে ছাড়ে না। রাবণ জটায়ুর বুকে দশ বাণ মারিয়া মনে করিল এইবার পাখি মারবে। কিন্তু পাখি মরা দূরে থাকুক, বরং সে রাবণের ধনুকটা কাড়িয়া লইল, তাহার উপর আবার তাহাকে একটা প্রকাণ্ড লাথিও মারিল। তারপর রাবণ আবার নূতন ধনুক লইয়া আগের চেয়ে অনেক বেশী বাণ মারিল বটে, কিন্তু জটায়ু কি তাহাতে ডরায়? বাণ তো তাহার ডানার বাতাসেই উড়িয়া গেল। তারপর ধনুকখানি কাড়িয়া লইয়া তাহা মাড়াইয়া গুঁড়া করিতে কতক্ষণ লাগে!

এমনিতর ভয়ানক যুদ্ধ করিয়া জটায়ু রাবণের রথ, ছাতা, সারথি, সহিস কিছুই আস্ত রাখিল