পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৮
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

না। কিন্তু সেই বুড়া বয়সে বেচারা আর কত যুদ্ধ করিবে? সে শীঘ্রই কাহিল হইয়া পড়িল।

 রাবণ দেখিল যে এইবেলা পালাইবার উত্তম সময়। সুতরাং সে হাতে একখানি খড়গ আর বগলে সীতাকে লইয়া চুপি-চুপি চলিয়া যাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া জটায়ু অমনি তাহাকে ধমক দিয়া বলিল, ‘দাঁড়া পাপী, যাইতেছিস কোথায়?” এই বলিয়া, হাতির পিঠে যেমন মাহুত চড়ে, সেইরূপ জটায়ু গিয়া রাবণের পিঠে চড়িল। তারপর তাহাকে ঠোকরাইয়া, আঁচড়াইয়া, চুল ছিড়িয়া এমনি নাকাল করিল যে নাকাল যাহাকে বলে!

 কিন্তু রাবণ সহজে মরিবার লোক ছিল না। ব্রহ্মা তাহাকে বর দিয়াছিলেন যে, তাহার শরীরের কোন জায়গা ছিঁড়িয়া গেলে তাহা তখনই জোড়া লাগিবে। জটায়ু তাহার বাম দিকের দশটা হাত ছিঁড়িয়া ফেলিতে না ফেলিতেই দেখিল যে, তাহার আর দশটা হাত বাহির হইয়াছে। এরূপ লোকের সঙ্গে কতক্ষণ যুদ্ধ করা যায়? কাজেই শেষটা জটায়ু আর পারিল না। তখন সেই দুষ্ট রাক্ষস খড়গ দিয়া বেচারার পা আর ডানা দুখানি কাটিয়া ফেলিল। জটায়ুর তখন প্রাণ যায়-যায়। এরপর আর সীতাকে কে রক্ষা করিবে? কাজেই তখন রাবণ তাঁহাকে লইয়া শূন্যে চলিয়া গেল।

 সীতার দুঃখের কথা আর কী বলিব! হায় হায়! তাহার সেই কান্না কেহই শুনিতে পাইল না। সেই শূন্যের উপর হইতে সীতা এমন একটি লোক দেখিতে পাইলেন না যাহাকে ডাকিয়া বলিতে পারেন, ‘আমাকে রক্ষা কর’। তিনি কেবল দেখিলেন যে, একটা পর্বতের উপর পাঁচটি বানর রহিয়াছে। তাহা দেখিয়া তিনি তাঁহার সোনালী রঙের চাদরখানি আর গায়ের গহনাগুলি ফেলিয়া দিলেন। মনে করিলেন, হয়ত তাহা দেখিতে পাইয়া তাহারা রামকে বলিবে। রাবণ ইহার কিছুই টের পাইল না, কিন্তু বানরেরা তাহা চাহিয়া দেখিল।

 এদিকে রাম সেই হরিণের-সাজ ধরা রাক্ষসটাকে মারিয়া তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরিতেছেন, তাঁহার মনে ভয়ের আর সীমা নাই। এমন সময় দেখিলেন, লক্ষ্মণ অতিশয় দুঃখিতভাবে সেই দিকে দিয়া আসিতেছেন। লক্ষ্মণকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, ‘সেকি লক্ষ্মণ, তুমি সীতাকে ফেলিয়া আসিয়াছ? না জানি কী সর্বনাশ হইয়াছে! সীতাকে হয়ত আর দেখিতে পাইব না।’

 এই বলিয়া তিনি তাড়াতাড়ি আশ্রমে আসিয়া দেখিলেন, সীতা নাই, খালি ঘর পড়িয়া রহিয়াছে। সীতা যে-সকল জায়গায় বেড়াইতেন, তাহার কোথাও তাঁহাকে খুঁজিয়া পাইলেন না।

 হায় হায়! সীতা কোথায় গেলেন? তিনি কি কোথাও লুকাইয়া আছেন? না বনে ফুল তুলিতে গিয়াছেন? না নদীতে স্নান করিতে গিয়াছেন? কোথায় তিনি? গাছতলায়, নদীর ধারে, পাহাড়ের উপরে, কত জায়গায় রাম সীতাকে খুঁজিলেন, কোথাও তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না। গাছকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেহই সীতার সংবাদ বলিতে পারিল না।

 তখন তিনি হাত পা ছুড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘হায় রে, লক্ষ্মণ, কে আমাদের সীতাকে লইয়া গেল? সীতা তুমি বুঝি লুকাইয়া থাকিয়া তামাসা দেখিতেছ? শীঘ্র আইস, আমার বড়ই কষ্ট হইতেছে। তুমি চলিয়া গেলে যে আমি আর বাঁচিব না।’

 লক্ষ্মণ তাহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, ‘দাদা, চল আরও ভাল করিয়া খুঁজি, তাহা হইলে হয়ত তাঁহাকে পাইব।’ কিন্তু রাম তবুও ‘সীতা, সীতা!’ বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। রামও কাঁদেন, লক্ষ্মণও কাঁদেন, আর চারিদিকে সীতাকে খোঁজেন।