পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 তখন সেই রাক্ষসটা বলিল, ‘তোমরা কে হে? এখানে কী করিতে আসিয়াছ? হাতে ধনুক, বাণ, খড়গ দেখিতেছি; গায়ে জোর আছে বলিয়া বোধ হয়। আর আমারও ক্ষুধা হইয়াছে। সুতরাং তোমাদিগকে খাইব।’ কিন্তু সে তাহার প্রকাণ্ড মুখ অথবা পেট, যাহাঁই বল হাঁ করিয়া যেইরাম লক্ষ্মণকে খাইতে যাইবে, অমনি লক্ষ্মণ খড়গ দিয়া তাহারা তাহার হাত দুইটা কাটিয়া ফেলিলেন। তখন সে বেদনায় অস্থির হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমরা কে?’ লক্ষ্মণ তাঁহাদের নিজের পরিচয় দিয়া বলিলেন, ‘তুমি কে?’ কবন্ধ হইলে কী করিয়া?

 রাম লক্ষ্মণের পরিচয় পাইয়া কবন্ধ বলিল, ‘আমার বড়ই সৌভাগ্য যে আজ তোমাদিগকে দেখিতে পাইলাম, আর তোমরা আমার হাত কাটিলে। আমার নাম দনু। এক সময়ে আমি বড় সুন্দর ছিলাম, আর ব্রহ্মার নিকট বর পাইয়াছিলাম যে অনেকদিন বাঁচিয়া থাকিব। ইহার মধ্যে একদিন আমি রাক্ষসের সাজ ধরিয়া স্থূলশিরা নামক এক মুনিকে ভয় দেখাইতে গেলাম। তাহাতে মুনি আমাকে শাপ দিলেন, “তুই ঐরূপ হইয়াই থাক্‌!” শাপ দূর করিয়া দিবার জন্য আমি অনেক মিনতি করিলে, তিনি বলিলেন, “রাম যখন তোর হাত কাটিয়া তোকে পোড়াইবেন, তখন আবার তোর সুন্দর চেহারা হইবে।”

 ‘এইরূপ করিয়া আমি রাক্ষস হইলাম। তারপর আবার একদিন আমি ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধ করিতে গেলাম। তাহাতে ইন্দ্র তাঁহার বজ্র দিয়া আমাকে এমন শাস্তি দিলেন যে, আমার মাথা আর পা একেবারে পেটের ভিতর ঢুকিয়া গেল। কিন্তু তবুও আমি মরিলাম না। তখন আমি এই বলিয়া দুঃখ করিতে লাগিলাম, “হায় হায়! ব্রহ্মার বরে যে আমাকে অনেক দিন বাঁচিয়া থাকিতে হইবে! এখন আমি খাইব কী করিয়া?” ইহাতে ইন্দ্র দয়া করিয়া আমাকে এই লম্বা হাতদুটা দিলেন। ইহা দিয়াই আমি এতদিন জীবজন্তু ধরিয়া খাইতেছি। রাম, তুমি আমাকে পোড়াইয়া ফেল। তাহা হইলে আমার আবার সুন্দর শরীর হইবে।”

 তারপর রাম লক্ষ্মণ প্রকাণ্ড চিতা জ্বালিয়া কবন্ধ কে তাহাতে পোড়াইলেন। সেই চিতার ভিতর হইতে সুন্দর চেহারা লইয়া কবন্ধ উঠিয়া আসিল; আর ঠিক সেই সময়ে একখানা হাঁসের টানা রথও সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই রথে চড়িয়া কবন্ধ রামকে বলিল, ‘সুগ্রীব নামে এক বানর আছে। তাহার বড় ভাই বালী তাহাকে রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দেওয়াতে সে এখন আর চারিটি বানর সঙ্গে করিয়া পম্পা নদীর ধারে ঋষ্যমূক পর্বতে ভয়ে ভয়ে বাস করে। সুগ্রীব যেমন বীর, তেমনি বুদ্ধিমান। তুমি তাহার সহিত বন্ধুতা কর। সে সীতার সন্ধানও করিতে পারিবে, তাঁহাকে পাইবার উপায়ও করিয়া দিবে।’

 এ কথায় কবন্ধের নিকট বিদায় লইয়া রাম লক্ষ্মণ সুগ্রীবকে খুঁজিবার জন্য পম্পা নদী ও ঋষ্যমূক পর্বতের দিকে যাত্রা করিলেন।

 পম্পার ধারে শবরী নামে একজন অতিশয় বুড়া তপস্বিনী বাস করিতেন। তিনি কেবল রামকে দেখিবার জন্যই এতদিন বাঁচিয়া ছিলেন। রামের সহিত দেখা হইলে তিনি বলিলেন, ‘রাম, তোমাকে যখন দেখিতে পাইয়াছি, তখন নিশ্চয়ই আমি স্বর্গে যাইতে পারিব। তোমার জন্য এই ফলমূল আনিয়া রাখিয়াছি, তুমি দয়া করিয়া তাহা লও।'

 এইরূপে রামকে আদর করিয়া, তাঁহার সম্মুখেই তিনি নিজের শরীর আগুনে পোড়াইয়া ফেলিলেন। তারপর সেই আগুনের ভিতর হইতে অতি সুন্দর বেশে বাহির হইয়া স্বর্গে চলিয়া গেলেন।