পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৬
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 তারপর সুগ্রীব সীতাকে খুঁজিবার জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইল। পূর্বে, দক্ষিণে, পশ্চিমে, উত্তরে, কোনখানেই লোক পাঠাইতে বাকি রহিল না। সুগ্রীব তাহাদিগকে বলিল, ‘এক মাসের মধ্যে তোমাদের ফিরিয়া আসা চাইনা আসিলে প্রাণদণ্ড হইবে।”

 এই সকল বানরের মধ্যে হনুমানও ছিল। সুগ্রীব তাহাকে ডাকিয়া বলিল, হনুমান, তুমি জলে, শূন্যে, স্বর্গে সকল স্থানেই যাইতে পার, আর সকল স্থানের খবর জান। তোমার মতন বীর কে আছে? যাহাতে খুব ভাল করিয়া সীতার খোঁজ হয়, তুমি সেইরূপ করবে। হনুমানকে দেখিয়া রামও বুঝিয়াছিলেন যে, সে নিশ্চয়ই সীতার সংবাদ আনিতে পারবে। তাই তিনি তাহার হাতে তাহার নিজের নাম লেখা একটি আংটি দিয়া বলিলেন, ‘এই আংটি দেখিলেই সীতা তোমাকে আমার লোক বলিয়া জানিতে পারবেন। হনুমান জোড় হাতে আংটিটি লইয়া রামকে প্রণাম করিল।

 তারপর বানরেরা সীতার খোঁজ করিবার জন্য গর্জন করিতে করিতে চারিদিকে ছুটিয়া চলিল। কেহ বলে, “আমি রাবণকে মারিয়া সীতাকে আনিব। কেহ বলে, “আরে না! তোমরা থাক, আমিই সব করিব।” কেহ বলে, “আমি পাহাড় গুড়া করিব। কেহ বলে, “আমি এক যোজন লাফাইব। কেহ বলে, “আমি দশ যোজন লাফাইব। কেহ বলে, আমি দশ হাজার যোজন লাফাইব।’

 এইরূপ করিয়া বানরেরা সীতাকে খুঁজতে বাহির হইল। ক্ষুধা হইলে তাহারা ফল খায়; রাত্রিতে গাছেই ঘুমায়। এক মাস পর্যন্ত এমনি করিয়া খুঁজিয়া, তাহারা পৃথিবীর কোন স্থান দেখিতে বাকি রাখিল না। কত দেশে, কত বনে, কত পাহাড়ে যে তাহারা গিয়াছিল, তাহার শেষ নাই।

 সমুদ্রে যে-সকল দ্বীপ আর পাহাড় আছে, সেখানে ভয়ঙ্কর কালো কালো জন্তু থাকে,— তাহদের কান পর্দার মত হইয়া ঠোট অবধি বুলিয়া পড়িয়াছে, তাহদের একটা বৈ পা নাই কিন্তু তবুও তাহারা বাতাসের মত ছোটে— সেইখানে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 যেখানে পিঙ্গলবর্ণ কিরাতেরা থাকে—তাহারা কাঁচা মাছ খায়—সেইখানে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 বাঘমুখো মানুষের দেশে, যব দ্বীপে, স্বর্ণ দ্বীপে, রৌপ্য দ্বীপে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল। ভয়ঙ্কর ইক্ষু সমুদ্রের ধারে বিকটাকার রাক্ষসেরা থাকে, তাহারা জন্তুর ছায়া ধরিয়া টানিয়া তাহাকে খায়। সেইখানে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 তারপর লাল সমুদ্র। সেখানে রাক্ষসেরা পাহাড়ের চুড়া ধরিয়া বাদুড়ের মত ঝুলিতে থাকে। সূর্যের তেজে তাহদের মাথা গরম হইয়া গেলে তাহারা সমুদ্রের জলে পড়িয়া যায়;সেখান হইতে ঠাণ্ড হইয়া আবার পাহাড়ে উঠিয়া ঝুলিতে থাকে। সেই লাল সমুদ্রে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 তারপর ক্ষীরোদ সমুদ্র। তারপর জলোদ সমুদ্র। সেখানে অতি বিশাল একটা ঘোড়ার মুখ হইতে ক্রমাগত আগুন বাহির হইতেছে আর তাহ দেখিয়া সমুদ্রের জন্তসকল ভয়ে চিৎকার করিতেছে। সেই জলোদ সমুদ্রে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল।

 যেখানে সূর্য উদয় হয়, সেই সোনার পর্বতে তাহারা সীতাকে খুঁজিয়াছিল। তাহার পরে কেবলই অন্ধকার; সেখানে কেহই যাইতে পারে না।