পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

দয়া করিয়া আমাকে সমুদ্রের জলে উড়াইয়া ফেলাতে, ইন্দ্র আমার পাখা কাটিতে পারেন নাই। হনুমান, তোমার পিতা আমার এই উপকার করিয়াছিলেন। তুমি কি আমার চূড়ায় একটু বিশ্রাম করিয়া আমাকে সুখী করিবে না?'

 হনুমান বলিল, 'মৈনাক, তোমার কথা শুনিয়াই আমার মনে যার-পর নাই সুখ হইয়াছে। কিন্তু ভাই, আমি ব্যস্ত আছি, এখন বসিতে পারিব না; আমাকে মাপ কর।’

 এই বলিয়া মৈনাককে ছুঁইয়া হনুমান আবার ছুটিয়া চলিল।

 দেবতারা দেখিলেন যে, হনুমান বড়ই ভয়ানক কাজ করিতে চলিয়াছে। এ কাজ সে করিয়া আসিতে পরিবে কি না তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে তাঁহাদের বড়ই ইচ্ছা হইল। তাই তাঁহারা নাগদিগের মাতা সুরসাকে ডাকিয়া বলিলেন, 'সুরসা ঠাকরুন, আপনি অনুগ্রহ করিয়া একটিবার হনুর পথটা আগলাইয়া দাঁড়ান তো! দেখি সে কেমন বীর!'

 দেবতাদের কথায় সুরসা ভয়ঙ্কর রাক্ষসীর বেশে, হাঁ করিয়া হনুমানের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। হনুমান তাহা দেখিয়া নিজের শরীরটাকে দশ যোজন বড় করিয়া ফেলিল। সে মনে করিয়াছিল যে, এত বড় হইলে আর রাক্ষসী তাকে গিলিতে পরিবে না। কিন্তু রাক্ষসী তখনই তাহার দশ যোজনের জায়গায় বিশ যোজন হাঁ করিয়া বসিল।

 কী বিপদ! হনুমান যতই বড় হয়, রাক্ষসী আমনি তাহার চেয়েও বড় হাঁ করে! দশ যোজন, বিশ যোজন, ত্রিশ যোজন, চল্লিশ যোজন, পঞ্চাশ যোজন, ষাট যোজন, সত্তর যোজন, আশী যোজন—হনুমান যতই বড় হইতেছে, রাক্ষসী তাহার চেয়ে বড় হাঁ করিতেছে! হনুমান মনে করিল, 'আর বড় হইয়া কী হইবে? অন্য উপায় দেখা যাক।’

 তখন সে হঠাৎ বুড়া আঙুলটির মতন ছোট্ট হইয়া রাক্ষসীর পেটের ভিতর ঢুকিয়া, আবার তখনই বাহির হইয়া আসিল। হনুমান খুবই তাড়াতাড়ি ছোট হইল, রাক্ষসীর মস্ত হাঁ-টাকে গুটাইয়া লইতে বোধহয় তাহার চেয়ে অনেক বিলম্ব হইয়াছিল। কাজেই হনুমানকে গিলা আর তাহার হয় নাই তারপর হয়ত আবার বুড়া আঙুলের মতন ছোট হনুমানটি কোনখান দিয়া ফসকিয়া গিয়াছে, রাক্ষসী তাহা টের পায় নাই। যেমন করিয়াই হউক, নাগের মা ঠাকরুনকে হনুমান বড়ই ফাঁকিটা দিয়াছিল। সুরসাকে ফাকি দিয়া বেশী দূর যাইতে না যাইতে হনুমান একটা রাক্ষসীর হাতে পড়িল। এটার নাম সিংহিকা। হনুমান শূন্যে ছুটিয়া চলিয়াছে, ইহার মধ্যে সিংহিকা তাড়াতাড়ি আসিয়া তাহার ছায়া ধরিয়া বসিল। হনুমান হঠাৎ দেখিল যে, সে আর চলিতে পারিতেছে না, আর সমুদ্রের ভিতর হইতে একটা ভয়ানক রাক্ষসীও উঠিয়া আসিতেছে। সে জানিত যে, এরকম ভয়ঙ্কর রাক্ষস আছে, তাহারা জন্তুর ছায়া ধরিয়া তাহাকে আটকাইয়া ফেলিতে পারে। সুতরাং সে বুঝিতে পারিল যে, এটা সেইরকম রাক্ষসী।

 তখন হনুমান তাহার শরীর বড় করতে লাগিল। রাক্ষসীও অমনি ঘোরতর গর্জনের সহিত একেবারে আকাশপাতাল জোড়া ভয়ঙ্কর এক হাঁ করিয়া হনুকে গিলে আর কি! তাহা দেখিয়া হনুমান খুব ছোট হইয়া রাক্ষসীর পেটের ভিতর ঢুকিল। সুতরাং রাক্ষসী যে হনুকে খাইতে চাহিয়াছিল, সে কাজ তাহার হইয়াছিল বলিতে হইবে; তবে দুঃখের বিষয়, হজমটা তেমন ভাল করিয়া হয় নাই। কারণ, হনু তাহার পেটের ভিতর গিয়াই তাহার নাড়িভুঁড়ি সব ছিঁড়িয়া প্রাণ বাহির করিয়া দিল। কাজেই হনুকে হজম করিবার অবসর আর বেচারির রহিল না।

 এতক্ষণে হনুমান লঙ্কার খুব কাছে আসিয়াছে; দূর হইতে সমুদ্রের তীরে সুন্দর সুন্দর