পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



ছেলেদের রামায়ণ
১৩৩

গাছপালা দেখা যায়। তখন হনুমান ভাবিল, ‘এই প্রকাণ্ড শরীর লইয়া লঙ্কায় গেলে রাক্ষসেরা কি মনে করিবে?' সুতরাং নামিবার পূর্বে সে তাহার শরীরটাকে খুব ছোট করিয়া লইল।

 সমুদ্র পার হইয়া হনুমান যেখানে নামিল সেটা পর্বত। এই পর্বতের নাম লম্ব পর্বত, ইহাকে ত্রিকূট পর্বতও বলে। এখান হইতে লঙ্কাপুরী বেশ দেখিতে পাওয়া যায়। নিজে বিশ্বকর্মা লঙ্কা তৈয়ারি করিয়াছিলেন। উহা স্বর্গের মত সুন্দর, আবার তেমনি মজবুত। লম্ব পর্বতের উপরেই শহর, তাহার চারিদিকে সোনার দেওয়াল। বড় বড় সিংহ-দরজা আছে, তাহাও সোনার। শহরের চারিধারে রাক্ষসেরা অস্ত্রশস্ত্র লইয়া পাহারা দিতেছে।

 দূর হইতে কিছুকাল লঙ্কার শোভা দেখিয়া তারপর হনুমান ধীরে ধীরে তাহার উত্তর দরজার নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তখনও বেলা ছিল বলিয়া পুরীর ভিতর ঢুকিল না। এত আলোর মধ্যে লঙ্কায় ঢুকিতে গেলে রাক্ষসেরা তাহাকে দেখিতে পাইয়া তাহার কাজই মাটি করিয়া দিবে। তাই বাকি বেলাটুকু সে চুপি-চুপি বাহিরেই কাটাইল। তারপর যখন নগরে ঢুকিতে গেল, তখন বেশ অন্ধকার হইয়াছে। তখন যে সে শহরে ঢুকিল, তাহাও একটি বিড়ালছানার মত ছোট হইয়া।

 লঙ্কার বাড়ি-ঘর যেমন বড় বড়, তেমনি সুন্দর। দরজা জানালা সোনার, রোয়াক পান্নার, সিঁড়িগুলি মানিকের। হনুমান এ-সকলের শোভা দেখিতে দেখিতে চলিয়াছে এমন সময় একটা বিকট রাক্ষসী কোথা হইতে আসিয়া তাহার পথ আটকাইয়া বলিল, ‘কে রে তুই বানর? এখানে কি করিতে আসিয়াছিস? সত্য বল্, নহিলে তোকে মারিয়া ফেলিব।’

 হনুমান বলিল, ‘বলিতেছি। আগে বল তুমি কে, আর কেনইবা এত রাগ করিতেছ।’ রাক্ষসী বলিল, ‘আমি এই স্থানের দেবতা, আমারই নাম লঙ্কা। এ স্থানের লোকেরা আমারই পূজা করে, আমি এখানে পাহারা দিই। আজ আমার হাতে তোর মরণ দেখিতেছি!’

 হনুমান তাহাতে কিছুমাত্র ভয় না পাইয়া বলিল, ‘এই সুন্দর নগরটি একবার দেখিতে আমার বড় ইচ্ছা হইয়াছে!’

 রাক্ষসী কহিল, ‘আমাকে হারাইতে না পারিলে তুই নগর দেখিতে পাইবি না।’ হনুমান আবার মিনতি করিয়া বলিল, ‘ঠাকরুন, আমি দেখিয়াই চলিয়া যাইব।’

 এ কথায় রাক্ষসী রাগিয়া হনুমানকে এক চড় মারিল। কাজেই তখন হনুমানেরও রাগ হইবে না কেন? তবে রাক্ষসী স্ত্রীলোক বলিয়া, তাহাকে বেশি মারিতে হনুমানের ইচ্ছা হইল না। সে কেবল বাঁ হাতে আস্তে তাহাকে একটি কিল মারিল, তাহাতেই বেচারী মাটিতে পড়িয়া, মুখ সিটকাইয়া একেবারে অজ্ঞান! জ্ঞান হইলে সে বলিল, ‘রক্ষা কর বাবা, আর না। ব্রহ্মা আমাকে বলিয়াছিলেন আমি যখন বানরের কাছে হারিব, তখন রাক্ষসদের বড় বিপদ হইবে। এখন সেই বিপদের সময় উপস্থিত দেখিতেছি। রাক্ষসদিগের আর রক্ষা নাই! এখন তুমি পুরীর ভিতর গিয়া যাহা ইচ্ছা কর।’

 তখন হনুমান প্রাচীর ডিঙাইয়া লঙ্কার ভিতর প্রবেশ করিল। সেখানে ঘরে ঘরে তিলতিল করিয়া খুঁজিল, কিন্তু কোথাও সীতার দেখা পাইল না।

 সে-সকল ঘরের কোথাও লোকজন গোলমাল করিতেছে, কোথাও পড়াশুনার শব্দ হইতেছে, কোথাও গুপ্তচরেরা অস্ত্রশস্ত্র লইয়া বসিয়া আছে। কোথাও সকলে মিলিয়া আমোদ করিতেছে; তাহাদের বাজনার শব্দ এমনি মিষ্ট যে, তাহাতে আপনা হইতে ঘুম আসিতে চায়।