পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১৩৭

তাঁহারাই বা কেমন করিয়া সীতাকে খুঁজিয়াছে, সে সকল কথার কিছুই সে তাঁহাকে বলিতে বাকি,রাখিল না। সকলে্র শেষে, রামের সেই আংটিটি তাঁহার হাতে দিল।

 আংটিটি দেখিয়া সীতার মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। তখন আনন্দে তাঁহার সেই সুন্দর মুখখানি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তারপর চিন্তিত হইয়া হনুমানকে রামের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। রাম-লক্ষণ কেমন আছেন? তাঁহারা কেন আসিয়া রাবণকে মারিয়া ফেলিতেছেন না? সীতাকে না দেখিয়া রামের শরীর বেশি রোগা হইয়া যায় নাই ত? এইরূপ কত প্রশ্নই তিনি করিলেন। রামের কথা যত জিজ্ঞাসা করেন, ততই তাঁহার আরো জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করে।

 হনুমান যার-পর-নাই মিষ্ট কথায় তাঁহার কথার উত্তর দিয়া তারপর বলিল, ‘মা আসুন, আপনাকে পিঠে করিয়া রামের কাছে লইয়া যাই।’

 তাহা শুনিয়া সীতা আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এতটুকু বানরটি হইয়া তুমি কি করিয়া আমাকে লইয়া যাইবে?’ হনুমান বলিল, ‘ইচ্ছা করিলেই মা আমি ঢের বড় হতে পারি।’

 এই বলিয়া সে দেখিতে দেখিতে পর্বতের মত বড় হইয়া বলিল, ‘মা, আপনার আশীর্বাদে রাবণ আর তাহার লোকজন ঘরবাড়ি সুদ্ধ এই লঙ্কাটাকে আমি মাথায় করিয়া লইয়া যাইতে পারি। আপনার কিছু ভয় নাই। আমার পিঠে উঠিয়া বসুন।’ সীতা বলিলেন, ‘তুমি যে পারিবে তাহা বুঝিয়াছি। কিন্তু সমুদ্রের উপর দিয়া যাইবার সময় আমি নিশ্চয়ই মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইব। কাজেই আমার যাওয়া ঠিক নহে। তুমি শীঘ্র তাঁহাদিগকে এখানে লইয়া আইস।’

 হনুমান বলিল, ‘আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আচ্ছা, তবে আমাকে এমন একটা কিছু জিনিস দিন যাহা দেখিয়া রামের বিশ্বাস হইবে যে আমি যথার্থই আপনাকে দেখিয়া গিয়াছি।’ একথায় সীতা তাঁহার মাথার মণি খুলিয়া হনুমানের হাতে দিলে হনুমান সেই মণি লইয়া, সীতাকে প্রণাম করিয়া তাঁহার নিকট বিদায় লইল। যাইবার সময় তাঁহাকে অনেক সাহস দিয়া বলিল, ‘মা আপনার কোন চিন্তা নাই, শীঘ্রই আপনার কষ্ট দূর হইবে।’

 সীতার নিকট বিদায় লইয়া হনুমান ভাবিতে লাগিল, ‘সীতার সন্ধান ত পাইয়াছি। এখন রক্ষসেরা কেমন যুদ্ধ জানে, তাহার কিছু খবর লইয়া যাইতে পারিলে মন্দ হয় না। আমি যদি এই সুন্দর অশোক বনটিকে নষ্ট করিয়া ফেলি তাহা হইলে রাক্ষসেরা নিশ্চয়ই আমার সহিত যুদ্ধ করিতে আসিবে। তখন আমিও তাহাদের বিদ্যা বুঝিতে পারিব।’

 এই বলিয়া হনুমান বিষম হুপ্ হাপ্, দুপ্ দাপ্, মড়্ মড়্ শব্দে অশোক বন ভাঙিতে আরম্ভ করিল। দেখিতে দেখিতে সেই বনের এমন দুর্দশা করিল যে আগুন দিয়া পিটাইলেও তাহার চেয়ে বেশি হয় না। এইরূপে সমস্ত বাগানটিকে ছারখার করিয়া সে একটি সিংহ-দরজার উপরে বসিয়া দেখিতে লাগিল, রাক্ষসেরা এখন কি করে।

 এদিকে রাক্ষসেরা বন ভাঙার শব্দে সেখানে আসিয়া দেখিল যে হনুমান তাহার কাজ শেষ করিয়া সিংহ-দরজায় চড়িয়া গর্জন করিতেছে। তখন তাহারা ঊর্ধ্বশ্বাসে গিয়া রাবণকে বলিল, ‘মহারাজ, একটা ভয়ঙ্কর বানর আসিয়া অশোক বন লণ্ডভণ্ড করিয়াছে। বোধহয় সে রামের লোক। সে সীতার সহিত কথা কহিয়াছে আর তিনি যেখানে আছেন সে জায়গাটুকু ভাঙে নাই।’

 এ কথা শুনিয়া রাবণ রাগে তাহার কুড়ি চোখ লাল আর কুড়ি পাটি দাঁত কড়্‌মড়্‌ করিয়া

উপেন্দ্র—১৮