পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১৩৯

ভরে একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়িয়া দিল। ব্রহ্মা তাহাকে সেই অস্ত্র দিয়াছিলেন। সে অস্ত্রকে কেহ আটকাইতে পারে না, কাজেই হনুমানও তাহাকে আটকাইতে পারিল না। আবার হনুমানকে ব্রহ্মা বর দিয়াছিলেন যে, কোন অস্ত্রেই তাহার মৃত্যু হইবে না। সুতরাং ব্রহ্মাস্ত্রও তাহাকে মারিতে না পারিয়া, খালি বাঁধিয়া ফেলিল।

 ব্রহ্মাস্ত্রে বাঁধা পড়িয়া হনুমান ভাবিল, ‘বেশ হইয়াছে! এখন এরা আমাকে রাবণের কাছে লইয়া যাইবে আর আমিও তাহার সহিত দুটা কথাবার্তা কহিতে পারিব।’

 হনুমান বাঁধা পড়িয়াছে দেখিয়া রাক্ষসেরা আনন্দে নাচিতে লাগিল। তাহাদের উৎসাহ দেখে কে! তাহারা মোটা মোটা শনের দড়ি আনিয়া তাহাকে ত শক্ত করিয়া বাঁধিল, তাহাছাড়া তাহাদের যতদূর সাধ্য গালি দিতে আর ভ্যাঙচাইতেও ছড়িল না। হনুমান কিছুই করে না, খালি চ্যাঁচাইতেছে।

 এদিকে কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্রের বাঁধন খুলিয়া গিয়াছে। কারণ, সে বাঁধন এমনি রকমের যে তাহার উপর আবার দড়ি দিয়া বাঁধিতে গেলে, তাহা আপনি খুলিয়া যায়। যাহা হউক, বাঁধন যে খুলিয়া গিয়াছে, এ কথা হনুমান রাক্ষসদিগকে জানিতে দিল না। ইন্দ্রজিৎ টের পাইল বটে, কিন্তু অন্য রাক্ষসেরা তাহার কিছুই বুঝিল না তাহারা মনে করিল, ‘বাঃ খুব মজবুত করিয়া বাঁধিয়াছি।’ তারপর বিস্তর টানাটানি আর ‘হেঁইয়ো! হেঁইয়ো! করিয়া তাহারা হনুমানকে মারিতে মারিতে বাবণের সভায় লইয়া চলিল।

 সেখানে রাক্ষসেরা তাহাকে দেখিয়া কি আশ্চর্যই হইল! কেহ বলিল, ‘আরে, এ বানর কে? এটা এখানে কি করিতে আসিল?’ কেহ বলিল, ‘এটাকে শীঘ্র মারিয়া ফেল!’ কেহ বলিল, ‘পোড়াইয়া ফেল!’ কেহ বলিল, ‘খাইয়া ফেল!’ এই বলিয়া তাহারা হনুমানকে লইয়া টানাটানি করিতে লাগিল।

 হনুমান কিছু বলে না। সে কেবল ক্রমাগত রাবণকে আর তাহার সভার ঘরখানি চাহিয়া দেখিতেছে। মণি-মানিকের কাজ করা স্ফটিকের সিংহাসনে রাবণ বসিয়া আছে। তাহার দশ মাথায় দশটি ঝকঝকে সোনার মুকুট। শরীরটি কুচকুচে কালো, তাহাতে রক্তচন্দন মাখানো, তাহার উপর সোনার হার। এক-একটা মুখ যেন এক-একটা জালা! তাহাতে আবার দাঁতগুলি ধারালো, আর ঠোঁটগুলি ঝুলিয়া পড়িয়াছে। হনুমান তাহাকে দেখিয়াই মনে মনে ভাবিল যে এ ব্যক্তি যেমন-তেমন বীর নহে!

 এদিকে রাক্ষসেরা হনুমানকে কত কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছে—'তুই কোথা হইতে আসিয়াছিস?’ এখানে আসিলি কি করিতে?’ ‘বন ভাঙিলি কেন?’ ‘কে তোকে পাঠাইয়াছে?’ 'ঠিক করিয়া বল্, তাহা হইলে এখনই তোকে ছাড়িয়া দিব, মিথ্যা কহিলে মারিয়া ফেলিব!'

 তাহা শুনিয়া হনুমান রাবণকে বলিল, ‘রাজা রাবণ, আমি বানর। তোমাকে দেখিতে লঙ্কায় আসিয়াছিলাম, সহজে তোমার দেখা না পাইয়া বন ভাঙিয়াছি! তাহাতে রাক্ষসেরা আমার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিল, কাজেই আমিও তাহাদিগকে মারিয়াছি। আমি রামের দূত, পবনের পুত্র, আমার নাম হনুমান। তোমার ধনজন এত আছে, তোমার কি এমন অন্যায় কাজ করা উচিত? তোমার ভালর জন্যই বলিতেছি, আমার কথা শোন সীতাকে রাখিও না, তাহা হইলে তোমার প্রাণ যাইবে। কি বলিব, রাম আমাকে অনুমতি দেন নাই, নহিলে আমি এখনই তোমার লঙ্কা গুঁড়া করিয়া রাখিয়া যাইতে পারিতাম।’