পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪০
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 তখন রাবণ তাহার লাল লাল কুড়িটা চোখ ঘুরাইয়া বলিল, ‘কোথারে জল্লাদসকল, কাট্‌ ত এটাকে!’ কিন্তু বিভীষণ তাহাকে বারণ করিল।

 বিভীষণ রাবণের ছোট ভাই, আর অতিশয় বুদ্ধিমান লোক। সে বলিল, ‘মহারাজ, করেন কি? দূতকে কখনও মারিতে আছে? তাহতে যে ভয়ানক পাপ। দূতকে চাবুক মারা যায়, তাহার মাথা মুড়াইয়া দেওয়া যায়, শরীরের কোন স্থান খোঁড়া করিয়াও মারা যায়, কিন্তু তাহাকে মারা কখনই হইতে পারে না। আর, এটাকে মারিয়া ফেলিলে খবর লইয়া কে যাইবে? তাহা হইলে রাম লক্ষ্মণই বা কি করিয়া এখানে আসিবে, আর রক্ষসেরাই বা কি করিয়া তাহাদিগকে মারিয়া, নিজেদের বাহাদুরি দেখাইবে!’

 বিভীষণের কথা শুনিয়া রাবণ বলিল, ‘বিভীষণ, ঠিক বলিয়াছে। ইহাকে মারিয়া কাজ নাই। এই দুষ্টের লেজ পোড়াইয়া দাও, তাহ হইলে দেশে গিয়া আর মুখ দেখাইতে পারিবে না!'

 তখন রাক্ষসেরা বোঝা বোঝা নেকড়া আনিয়া হনুমানের লেজে জড়াইতে লাগিল। যত জড়ায় হনুমানের লেজ ততই বড় হয়, আর বেশি নেকড়া লাগে। লঙ্কার নেকড়া ফুরাইয়া যাইবার গতিক আর-কি! নেকড়া জড়ান হইলে, তাহাতে তেল ঢালিয়া আগুন ধরাইয়া দিল।

 সেই লেজের আগুন দিয়া হনুমান যে কি কাণ্ড করিবে, তাহা আগে জানিলে কখনই তাহারা এমন করিয়া তাহাতে আগুন ধরাইত না। হনুমান প্রথমেই ত সেই জ্বলন্ত লেজখানি ঘুরাইয়া রাক্ষসদিগকে মারিতে আরম্ভ করিল। যত মারে রাক্ষসেরাও ততই বেশি করিয়া তাহাকে বাঁধে, আর তাহাকে দেখিয়া ছেলে, বুড়ো, আর স্ত্রীলোকেরা হাততালি দিয়া হাসে। এইরূপ করিয়া রাক্ষসেরা লঙ্কার গলি গলি হনুমানকে লইয়া তামাশা দেখাইতে লাগিল। অবশ্য, এ খবর সীতার কাছে পৌঁছিতে অধিক বিলম্ব হইল না। তাহা শুনিয়া সীতা মনে মনে বলিলেন, ‘হে দেবতা অগ্নি, আমি যদি কোন পুণ্য কাজ করিয়া থাকি, তবে তুমি হনুমানকে পোড়াইও না।’

 এদিকে হনুমান ভাবিতেছে, ‘কি আশ্চর্য! আমার লেজে এত আগুন, তবু তাহাতে জ্বালা নাই কেন? আগুন যে আমার কাছে হিমের মতন লাগিতেছে। বুঝিয়াছি, আমার পিতা পবন, আর রাম, আর সীতা, ইঁহাদের দয়াতেই এইরূপ হইয়াছে।'

 তখন সে মুহূর্তের মধ্যে তাহার শরীরটাকে খুব ছোট করিয়া ফেলিল। তাহাতে বাঁধনের দড়িগুলি আপনা হইতেই খুলিয়া পড়ায়, রাক্ষসেরা আর তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।

 তারপর একটা প্রকাণ্ড দরজার হুড়কা লইয়া রাক্ষসগুলির মাথা ভাঙিতে আর কতক্ষণ লাগে!

 বাঁধন ঝাড়িয়া ফেলিয়া হনুমান ভাবিল, ‘এখন কি করি? সমুদ্র ডিঙাইয়া বন ভাঙিয়া, রাক্ষস অনেক মারিয়াছি। এখন এই লেজের আগুন দিয়া এই সকল ঘর দুয়ার পোড়াইতে পারিলেই কাজ শেষ হয়।’

 যেই এই কথা মনে করা, আমনি এক লাফে একেবারে ঘরের চালে গিয়া উঠা। তারপর ঘর হইতে ঘরে, সেখান হইতে বাগানে, বাগান হইতে আবার ঘরের ছাদে, এইরূপ করিয়া হনুমান লঙ্কায় আগুন লাগাইয়া ফিরিতে লাগিল। আগে প্রহস্তের বাড়ি, তারপর মহাপার্শ্বের বাড়ি, তারপর বজ্রদংষ্ট্র, ইন্দ্রজিৎ, জাম্বুমালী, মকরাক্ষ, নরান্তক, কুম্ভ, নিকুম্ভ এইরূপ করিয়া একেবারে রাজার বাড়ি পর্যন্ত কিছুই বাকি রহিল না। আগুন যতই জ্বলিয়া উঠিল, বাতাসও