পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৪
উপেন্দ্রকিশাের রচনাসমগ্র

মৃত্যুতে তাহা ভুলিয়া গিয়া সে কাঁদিয়া অস্থির হইল। রাম তাহাকে অনেক বুঝাইয়া শান্ত করিলেন।

 আহা! লঙ্কার রাণীরা তখন কি কাতর হইয়াই কাঁদিয়াছিল, সে কান্না শুনিলে বুঝি পাথরও গলিয়া যায়। তাহাদের ত আর কোন দোষ ছিল না; কাজেই তাহাদের দুঃখে কাহার না দুঃখ হইবে? তাহাদিগকে শান্ত করিবার ক্ষমতা কাহারও হইল না। শেষে তাহারা নিজেরাই একে অন্যকে বুঝাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া রাম বিভীষণকে বলিলেন, ‘ইহাদের দুঃখ আমি আর সহিতে পারিতেছি না; শীঘ্র রাবণকে পোড়াইবার আয়োজন কর।’

 তখন সকলে মিলিয়া রাবণকে রেশমী পোশাকে সাজাইয়া, সোনার পাল্কিতে করিয়া, শ্মশানে লইয়া গেল। সেখানে চন্দনকাঠের চিতায় অনেক জাঁকজমকের সহিত তাহাকে পোড়ানো হইল। তারপর রাম বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করিলেন।

 তখন সকলে সীতার কথা বলিবার সময় হইয়াছে। দুঃখিনী সীতা এখনও সেই ময়লা কাপড়খানি পরিয়া, বিনা স্নানে, এলো চুলে, চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে অশোক বনে দিন কাটাইতেছেন। তাঁহার দুঃখের সময় কখন ফুরাইযাছে, তাহা তিনি জানিতেও পারেন নাই। এমন সময় হনুমান আসিয়া প্রণাম করিয়া, তাঁহাকে রাবণের মৃত্যুসংবাদ দিল।

 সুখ বা দুঃখ বেশি হইলে লোকে ব্যস্ত হইয়া উঠে। কিন্তু সেই সুখ বা দুঃখ যদি নিতান্তই বেশি রকমের হয়, তবে প্রায়ই ব্যস্ত হইবাব অবসর থাকে না। তখন লোকে কেমন হতবুদ্ধির মত হইয়া যায়। হনুমানের কথা শুনিয়া, সীতাও অনেকক্ষণ সেইরূপ হইয়া রহিলেন। তারপর একটু সুস্থ হইয়া হনুমানকে বলিলেন, ‘বাছা, যে সংবাদ তুমি দিলে, আমি দীন দুঃখিনী তাহার উপযুক্ত পুরস্কার কি দিব?’

 কিন্তু হনুমান পুরস্কাবের ধার ধারে না। সীতা যে সুখী হইয়াছেন ইহাই তাহার পক্ষে ঢের, সে আর কিছু চাহে না। তবে, একটা কাজ করিতে পারিলে তাহার মনটা আরও খুশি হইত। দুষ্ট রাক্ষসীরা সীতাকে কিরূপ কষ্ট দিত তাহা সে নিজের চক্ষে দেখিয়াছে। সেই রাক্ষসীগুলির ঘাড় ভাঙিতে হনুমানের বড়ই ইচ্ছা ছিল। সীতার অনুমতি পাইলে, সে ইহাদের কি দশা করিত তাহা সে-ই জানে!

 কিন্তু সীতার প্রাণে এতই দয়া যে যাহারা তাঁহাকে এত কষ্ট দিয়াছে, তাহাদিগকেও কোনরূপ কষ্ট দিতে তাঁহার ইচ্ছা হইল না। তাই তিনি হনুমানকে বলিলেন, ‘বাছা এমন কাজ করিও না! উহারা গরিব লোক, যাহা করিয়াছে রাবণের হুকুমেই করিয়াছে আসলে উহাদের কোন দোষ নাই।’

 তারপর সীতা রামের নিকট আসিতে প্রস্তুত হইলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, যেরূপ আছেন ঠিক সেইরূপ মলিন বেশেই তিনি রামের কাছে আসেন। কিন্তু সকলে তাঁহাকে স্নান করাইয়া, সুন্দর কাপড় আর অলঙ্কার পরাইয়া দিল। এতদিন পরে রামকে দেখিয়া তাঁহার মনে না জানি কতই সুখ হইয়াছিল। কিন্তু হায়! সে সুখ তাঁহার অধিকক্ষণ রহিল না।

 সীতা আসিলে রাম তাঁহাকে বলিলেন, ‘সীতা, তুমি রাক্ষসদিগের সঙ্গে এতদিন ছিলে। এখন তুমি আমাদিগকে আগেকার মতন ভালবাস কি না তা কি করিয়া বলিব? আমি রাবণকে মারিয়া তাহার উচিত শাস্তি দিয়াছি। এখন তোমার যেখানে ইচ্ছা, সেইখানে চলিয়া যাও।’

 সীতা কত দুঃখই সহিয়াছেন, কিন্তু রামের এই কথায় তাঁহার মনে যে দুঃখ হইল, সে