পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১৬৫

দুঃখ আর তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, ‘হায় হায়, আমার আর বাঁচিয়া কি কাজ? লক্ষ্মণ, আগুন জ্বালিয়া দাও, আমি তাহাতে পুড়িয়া মরিব?’

 তখন লক্ষ্মণ রাগে আর দুঃখে চিতা প্রস্তুত করিয়া আগুন জ্বালিয়া দিলেন, আর সেই আগুনে সীতা ঝাঁপ দিয়া পড়িলেন।

 আহা! সংসারের সকল সুখ দিলেও যে সীতার গুণের পুরস্কার হয় না, যাঁহার দুঃখ দূর করিবার জন্য এত জনের প্রাণ দিতে হইল, সেই সীতার কিনা শেষে এই দশা!

 কিন্তু কি আশ্চর্য! আগুনে সীতার মাথার একগাছি চুলও পুড়িল না। সকলে অবাক হইয়া দেখিল যে নিজে দেবতা অগ্নি সীতাকে কোলে করিয়া, চিতা হইতে উঠিয়া আসিতেছেন। সীতা দেখিতে সকালবেলার সূর্যের ন্যায় উজ্জল;তাঁহার পরনে লাল কাপড়, গায় অলঙ্কার, গলায় মালা। অগ্নি সীতাকে রামের কাছে দিয়া বলিলেন, ‘সীতার কোন দোষ নাই।’ তখন রাম মনের সুখে পরম আদরের সহিত সীতাকে লইলেন।

 এদিকে রাম সীতাকে দেখিবার জন্য দেবতারা সকলে উপস্থিত হইয়াছে। তাঁহাদের সঙ্গে দশরথও আসিয়াছেন। দশরথকে দেখিয়া রাম লক্ষ্মণ প্রণাম করিলেন। দশরথ রামকে আদর করিয়া বলিলেন, ‘বাছা, স্বর্গে বড় সুখে আছি, কেবল কৈকেয়ীর সেই কথাগুলি মনে হইলে আজও খুব কষ্ট হয়। আজ তোমাদিগকে দেখিয়া আমার সে কষ্ট দূর হইল। আমার জন্য তুমি এতদিন বনে থাকিলে, আর রাবণকে মারিয়া দেবতাদের উপকার করিলে এখন দেশে গিয়া সুখে রাজত্ব কর।’

 রাম হাতযোড় করিয়া দশরথকে বলিলেন, ‘বাবা, মা কৈকেয়ী আর ভাই ভরতের উপর আপনার যদি রাগ থাকে, তবে তাহা দূর করুন।’ রামের এই কথায় দশরথ সম্মত হইয়া রাম সীতা আর লক্ষণকে আশীর্বাদ করিয়া স্বর্গে চলিয়া গেলেন।

 দশরথ চলিয়া গেলে পর ইন্দ্র রামকে বলিলেন, ‘রাম, আমরা তোমার উপর সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি বর লও।’

 রাম বলিলেন, ‘তবে আমাকে এই বর দিন যে আমার উপকার করিতে আসিয়া, যেসকল বানর মরিয়াছে তাহারা আবাব বাঁচিয়া উঠুক। আর তাহাদের দেশের গাছে অনেক ফল আর নদীতে অনেক জল হউক।’

 ইন্দ্র বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে।’ এই কথা শেষ হইতে না হইতেই, যত বানর যুদ্ধে মরিয়াছিল সকলেই আবার উঠিয়া বসিল—যেন এইমাত্র তাহাদের ঘুম ভাঙিয়াছে।

 তারপর দেবতারা রাম লক্ষ্মণকে আদর করিয়া বলিলেন, ‘এখন তোমরা মনের সুখে অযোধ্যায় চলিয়া যাও। সেখানে সকলেই তোমাদের জন্য দুঃখিত রহিয়াছে। আর সীতাও অনেক কষ্ট পাইয়াছে, তাহাকে শান্ত কর।’ এই বলিয়া দেবতারা আবার স্বর্গে চলিয়া গেলেন।

 ততক্ষণে সন্ধ্যা হইয়াছিল; কাজেই রাম সকলকে বিশ্রাম করিতে বলিলেন। সে রাত্রি সকলের কি সুখেই কাটিল! এমন সুখের রাত্রি খুব কমই হইয়া থাকে।

 রাবণ মরিল, বনবাসেরও দিন ফুরাইয়া আসিল। এখন অযোধ্যায় ফিরিবার সময়। তাহা দেখিয়া বিভীষণ রামকে বলিল, ‘আমার ভাই রাবণ কুবেরের পুষ্পক রথখানি কাড়িয়া আনেন। এখন সেই রথ আপনারই। এই রথে এক দিনেই অযোধ্যায় যাইতে পারিবেন। কিন্তু আমি মিনতি করিয়া বলিতেছি, আর একটি দিন আমার এখানে থাকিয়া যাউন।’