পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের রামায়ণ
১৬৭

আজ তুমি যে সংবাদ আমাকে শুনাইলে, তাহার উপযুক্ত পুরস্কার আমি তোমাকে কি দিব? তুমি এক লক্ষ গরু আর একশতখানি গ্রাম লও!’

 তারপর হনুমান কুশাসনে বসিয়া রামের সকল সংবাদ ভরতকে শুনাইয়া, শেষে বলিল, ‘তিনি এখন ভরদ্বাজের আশ্রমে আছেন। কাল এইখানে আসিবেন।’

 আজ যদি পৃথিবীতে সুখী কেহ থাকে, তবে সে এই অযোধ্যার লোক। সুখী কেন হইবে না? চৌদ্দ বৎসর ধরিয়া যে রামের দুঃখে তাহারা চক্ষের জল ফেলিয়াছে ভাল করিয়া খায় নাই, ভাল কাপড় পরে নাই, সেই রাম এতদিনে দেশে ফিরিতেছেন। তাই আজ সকলে পথঘাট পরিষ্কার করিয়া, বাড়ি ঘর সাজাইয়া, নিশান উড়াইয়া, বাজনা বাজাইয়া রামকে দেখিতে চলিল। পাল্কি চড়িয়া রাণীরা চলিলেন, ব্রাহ্মণ প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া ভরত চলিলেন—তাঁহার মাথায় রামের সেই খড়মজোড়া।

 যেই রামের রথ দেখা গেল, অমনি সকলে ‘ঐ রাম!’ শব্দে আকাশ ফাটাইয়া দিল।

 তখন যে সকলের মনে খুবই আনন্দ হইয়াছিল, তাহাতে আর সন্দেহ কি? আর, সকলেই তখন যে রামকে প্রাণ ভরিয়া আদর করিবার জন্য ব্যস্ত হইবে, তাহাও আশ্চর্য নহে। যাহারা তাঁহার চেয়ে ছোট, তাহারা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া আশীর্বাদ লইল। রামও মা কৌশল্যা আর অন্যান্য রাণীদিগকে আর বশিষ্ঠ প্রভৃতি গুরুজনকে প্রণাম করিলেন।

 তারপর ভরত রামের সেই খড়মজোড়া তাঁহার পায়ে পরাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘দাদা, তোমার রাজ্য আমাকে রাখিতে দিয়া গিয়াছিলে, এখন তাহা তুমি ফিরাইয়া লও। তোমার রাজ্য এখন আগের চেয়ে দশগুণ বড় হইয়াছে।’

 তারপর ক্ষুর হাতে ভাল ওস্তাদ নাপিতেরা আসিয়া রামের চৌদ্দ বছরের জটা চাঁছিয়া পরিষ্কার করিল। শত্রুঘ্ন রাম লক্ষ্মণকে স্নান করাইয়া নিজ হাতে তাঁহাদিগকে সাজাইয়া দিলেন। সুগ্রীব, বিভীষণ প্রভৃতি আর যত লোক সঙ্গে আসিয়াছিল, কাহারও আদর যত্নের কোন ত্রুটি হইল না। নিজে মা কৌশল্যা যখন বানরের মেয়েদিগকে সাজাইলেন তখন কিরূপ আদর-যত্ন হইল বুঝিতেই পার।

 অবশেষে বশিষ্ঠ প্রভৃতি মুনিরা রাম সীতাকে মাণিকের পিঁড়ির উপর বসাইয়া তাঁহাদের অভিষেক করিলেন। সে অভিষেক কি চমৎকার হইয়াছিল, তাহা কি না দেখিলে বঝিতে পারা যায়? দেবতারা পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন, অন্য কথায় আর কাজ কি?

 যত ভাল ভাল তীর্থ আছে সকল তীর্থের জল দিয়া রামকে স্নান করানো হইল। স্নানের পর রাম রাজবেশে রত্নের পিঁড়িতে সভা আলো করিয়া বসিলেন। তাঁহার মাথায় সেই মনুর সময় অবধি যাহা অযোধ্যার রাজারা মাথায় দিয়া আসিতেছে, সেই আশ্চর্য মুকুট। দুই পাশে সাদা চামর হাতে সুগ্রীব আর বিভীষণ; পিছনে সাদা ছাতাখানি লইয়া শত্রুঘ্ন। তখন ইন্দ্রের হুকুমে পবন আসিয়া তাঁহার গলায় স্বর্গের সোনার পদ্মের মালা আর আশ্চর্য মোতির হার পরাইয়া দিলেন।

 এইরূপ করিয়া দেবতা গন্ধর্বের গান আর আনন্দ-কোলাহলের ভিতরে রাম অযোধ্যার রাজা হইলেন। তেমন রাজা আর কেহ কখনও দেখে নাই। আজও খুব ভাল রাজার কথা বলিতে হইলে লোকে বলে, ‘রামের মতন রাজা!’