পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭২
উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র

 তখনই বিদুরকে ডাকানো হইল। বিদুর যুধিষ্ঠিরের কাকা হন। এমন সরল সাধুলোক পৃথিবীতে খুব কমই জন্মিয়াছে। বিদুর আসিলে কুন্তী সকল কথা তাঁহাকে জানাইয়া, শেষে বলিলেন, “বুঝি-বা দুর্যোধনই আমার ভীমকে মারিয়া ফেলিল। ও দুষ্ট ভীমকে বড়ই হিংসা করে!”

 বিদুর বলিলেন, “বৌদিদি, চুপ, চুপ! আপনার এ কথা দুর্যোধন শুনিতে পাইলে বড়ই বিপদ ঘটাইবে। ভীমের জন্য আপনি কোনো চিন্তা করিবেন না। আমি ব্যাসদেবের মুখে শুনিয়াছি যে, আপনার ছেলেরা অনেকদিন বাঁচিয়া থাকিবেন। ব্যাসের কথা কি মিথ্যা হইতে পারে? আপনার কোনো ভয় নাই, নিশ্চয় ভীম ফিরিয়া আসিবেন!” এই বলিয়া বিদুর চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাঁহার কথায় কুন্তী আর তাঁহার পুত্রগণের মনের দুঃখ ঘুচিল না৷

 এদিকে ভীমও আটদিনের লম্বা ঘুমের শেষে জাগিয়া উঠিয়াছেন। অমৃত খাইয়া তাঁহার শরীরে দশহাজার হাতির বল হইয়াছে। সাপেরা তাঁহাকে স্নান করাইয়া সাদা কাপড় আর সাদা মালা পরাইয়া, পায়স রাঁধিয়া খাওয়াইয়া, পরম আদরের সহিত সেই প্রমাণকোটির স্নানের জায়গায় রাখিয়া গেল। সেখানে আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়া তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলিয়া আসিলেন৷

 মরা ছেলে বাঁচিয়া উঠিলে মা-বাপ যেমন খুশি হয়, ভীমকে পাইয়া সকলে তেমনি সুখী হইলেন। তারপর তাঁহার মুখে সকল কথা শুনিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, “ভাই সাবধান! এ সব কথা যেন আর কেহ না জানে৷”

 তখন হইতে পাঁচ ভাই যারপরনাই সাবধান হইয়া চলিতে লাগিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন আর দুর্যোধনের মামা শকুনি কতরকমে তাঁহাদিগকে হিংসা করেন, তাঁহারা সে-সব জানিতে পারিয়াও চুপ করিয়া থাকেন। এইরূপ করিয়া দিন যাইতে লাগিল৷

 শিশুকাল হইতেই লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের ছেলেরা ধনুর্বিদ্যা (অর্থাৎ ধনুক দিয়া তীর ছোঁড়া) শিখিতে আরম্ভ করে। যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন প্রভৃতি সকলেই একসঙ্গে কৃপাচার্য নামক একজন খুব ভালো শিক্ষকের নিকট ধনুর্বিদ্যা শিখিতে লাগিলেন৷

 এই সময়ে একদিন ছেলেরা শহরের বাহিরে একটা লোহার গোলা লইয়া খেলা করিতেছিল। খেলিতে খেলিতে গোলাটা একটা শুকনো কুয়ার ভিতরে পড়িয়া গেল, ছেলেরা অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই তাহা তুলিতে পারিল না। গোলা তুলিতে না পারায় অপ্রস্তুত হইয়া তাহারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতেছে, এমন সময়, সেইখান দিয়া একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ যাইতেছিলেন। ছিপ্‌ছিপে কালো-হেন লোকটি, পাকাচুল, হাতে তীর-ধনুক। ছেলেদের দুর্দশা দেখিয়া তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দুয়ো! দুয়ো! তোমরা ক্ষত্রিয় হইয়া এই গোলাটা তুলিতে পারিলে না! দুয়ো! দুয়ো! আমাকে কি খাইতে দিবে বল, আমি গোলা তুলিয়া দিতেছি! গোলাও তুলিব, আর আমার এই আংটি কুয়ায় ফেলিতেছি তাহাও তুলিব।” এই কথা বলিয়া তিনি তাঁহার আংটিও কুয়ায় ফেলিয়া দিলেন৷

 তখন যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মহাশয়, আপনি যদি গোলাটা তুলিতে পারেন তবে চিরকাল খাইতে পাইবেন৷”

 ব্রাহ্মণ হাসিতে হাসিতে একমুঠো শর লইলেন। তারপর তাহার একটি শর গোলায় বিঁধাইয়া, সেই শরের পিছনে আর-একটি শর বিঁধাইয়া তাহার পিছনে আবার আর-একটি—