পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/১৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
১৮৫

 এদিকে পাণ্ডবদের যাত্রার সময় উপস্থিত, রথ প্রস্তুত। পাণ্ডবেরা গুরুজনকে প্রণাম, সমান বয়সীদের সঙ্গে কোলাকুলি, ছোটদিগকে আশীর্বাদ আর প্রজাদিগকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া রথ ছড়িয়া দিলেন। বিদুর প্রভৃতি কয়েকজন লোক অতিশয় দুঃখের সহিত কিছুদূর তাঁহাদের পিছু পিছু চলিলেন। এদিকে ব্রাহ্মণেরা ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দা করিয়া বলিতে লাগিলেন, ধৃতরাষ্ট্র দুষ্টলোক তাই এমন কাজ করিল। পাণ্ডবেরা তো কোনোদিন তাহাদের কোনো ক্ষতি করে নাই। আর ভীষ্মকেই বা কি বলি? তাঁহার চোখের সামনে এমন অধর্ম হইল, আর তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। আইস আমরাও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে চলিয়া যাই৷

 যুধিষ্ঠির তাঁহাদিগকে বলিলেন, ‘দেখুন, জ্যেঠামহাশয় আমাদের গুরুলোক, তাঁহার কথা শুনিয়া চলাই আমাদের উচিত। আপনারা আমাদের পরম বন্ধু, আমাদিগকে আশীর্বাদ করিয়া এখন ঘরে ফিরুন। ইহাতে শেষে আমাদের উপকার হইবে৷’

 এ কথায় তাঁহারা পাণ্ডবদিগকে আশীর্বাদ করিয়া ঘরে ফিরিলেন। বিদুর এতক্ষণ চুপিচুপি আসিতেছিলেন। তাঁহাদিগকে ফিরিতে দেখিয়া, সময় বুঝিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, ‘বাবা যুধিষ্ঠির! বিপদ আসিলে বুদ্ধিমান লোকে তাহা এড়াইবার চেষ্টা করেন। গর্তের ভিতরে থাকিলে আগুনে পোড়াইতে পারে না। লোহার অস্ত্র নয়, কিন্তু তাহাতে শরীর কাটে, তাহার কথা যে জানে, শত্রুরা তাহাকে মারিতে পারে না। অন্ধ হইলে পথ দেখিতে পায় না, ব্যস্ত হইলে বুদ্ধি ঠিক থাকেনা। এইটুকু বলিলাম, বুঝিয়া লও। চলাফেরা করিলেই পথ জানা যায়, নক্ষত্র দিয়া দিক ঠিক করা যায়, আর নিজের মন বশে থাকিলে ভয়ে কাবু হইতে হয় না৷’

 এই কথাগুলি বিদুর যে কিরকম একটা ভাষায় বলিলেন, কেহ তাহার অর্থ বুঝিতে পারিল না! কেবল যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘বুঝিয়াছি।’ সকলে চলিয়া গেলে কুন্তী তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাবা! বিদুর যে কি বলিলেন, আর তুমিও বলিলে বুঝিয়াছি’ আমি তো তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না৷

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘মা! দুর্যোধন নাকি আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিতে চাহে। তাই কাকা আমাকে সাবধান করিয়া দিলেন, আর সর্বদা পথ-ঘাটের খবর লইতে, আর ভালো হইয়া চলিতে বলিলেন!’

 তারপর কিচ্ছুদিন পথ চলিয়া তাঁহারা বারণাবতে পৌঁছিলেন। তাহাদিগকে পাইয়া সেখানকার লোকদিগের খুবই আনন্দ হইল। পাণ্ডবেরা নিতান্ত গরিবদেরও বাড়ি বাড়ি গিয়া দেখা করিলেন। পুরোচন তো প্রথমেই আসিয়া তাঁহাদের সঙ্গে জুটিয়াছে। তাহাদিগকে পাইয়া যেন কত খুশি! দুষ্টের মুখে হাসি আর ধরে না, কুমিরের মতন তাহার দাঁত খালি বাহির হইয়াই আছে। পাণ্ডবদিগকে সে আগে অন্য একটা সুন্দর বাড়িতে খুব আদরের সহিত দশদিন রাখিয়া তারপর তাঁহাদিগকে সেই গালার বাড়িতে নিয়া উপস্থিত করিল। সে বাড়িতে গিয়াই যুধিষ্ঠির চুপিচুপি ভীমকে বলিলেন, ‘ভাই! আমি চর্বি আর গালার গন্ধ পাইতেছি। এ বাড়িটা নিশ্চয়ই গালা, চর্বি, শুকনো বাঁশ প্রভৃতি জিনিসের তৈরি। দুষ্ট আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিবার জন্য এইখানে আনিয়াছে। বিদুর কাকা ইহার কথা জানিতে পারিয়াই আমাকে ওরূপ বলিয়াছিলেন৷’

 এ কথা শুনিয়া ভীম বলিলেন, ‘তবে আসুন আমরা এখান হইতে চলিয়া যাই৷’

উপেন্দ্র—২৪